ইউক্রেনের রাশিয়া তাদের লক্ষ্য হাসিল করলেও ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে যুদ্ধ বাধাতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু রাশিয়াকে চিরকালের মতো দূর্বল করে দেয়ার চক্রান্তে সফল হতে পারেনি। বরং রাশিয়া সমৃদ্ধ ডনবাস অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আরও শক্তিশালী হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে ফোন দিয়েছিলেন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন। শুক্রবার রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এ তথ্য নিশ্চিত করে জানিয়েছে, তাদের মধ্যে আলোচনা করা বিষয়গুলোর মধ্যে ইউক্রেনের পরিস্থিতি ছিল।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তার পশ্চিমা মিত্রদের নিয়ে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিলেও তাতে খুব একটা সফলতা আসেনি। এর মূল কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো জোটে মতপার্থক্য। বর্তমানে ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে স্পষ্টতই দুটি ভাগ দেখা দিয়েছে। এক দিকে আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তাদের মুখাপেক্ষী ফিনল্যান্ড, লিথুয়ানিয়ার মতো কিছু দেশ। অপরদিকে রয়েছে ইউরোপকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দেয়া জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির মতো শক্তিশালী দেশ। এই সপ্তাহে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ এবং ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি রাশিয়ার বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগের বদলে আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির উপরে জোর দিয়েছেন। ওয়াশিংটনে বক্তৃতায় দ্রাঘি বলেন, পশ্চিমা নেতাদের উচিত ‘যুদ্ধবিরতি আনার এবং আবার কিছু বিশ্বাসযোগ্য আলোচনা শুরু করার সম্ভাবনার দিকে কাজ করা।’ তিনি যোগ করেছেন, ‘ইতালি এবং ইউরোপে এখন মানুষ এই গণহত্যা এবং এই সহিংসতা, এই হত্যাকাণ্ডের অবসান চায়।’
‘এটি আমাদের লক্ষ্য,’ ম্যাখোঁ একইভাবে এই সপ্তাহে শলৎসের সাথে একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন। তিনি যোগ করেছেন যে, শান্তি অর্জনের একমাত্র উপায় হল ‘আলোচনার টেবিলে রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয়ের অংশগ্রহণ।’ ফরাসি নেতা ইউক্রেনের দাবির বিষয় উপেক্ষা করেছেন, তবে পশ্চিমা নেতারা বলেছেন যে, ‘ইউক্রেনকে যে শর্তাদি নির্ধারণ করবে সে বিষয়ে আলোচনায় সহায়তা করা উচিত।’ এবং দ্রাঘি ও শলৎজ জোর দিয়েছেন যে, ইউক্রেনীয়দের জন্য কোন আদেশমূলক শর্ত থাকতে পারে না।
কিন্তু ইউক্রেনের নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের উস্কানির কারণে এ পর্যায়ে যুদ্ধবিরতি বা সমঝোতার কথা শোনার মেজাজে নেই। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র সচিব লিজ ট্রাস এবং প্রতিরক্ষা সচিব বেন ওয়ালেস ইউক্রেনীয়দের প্রতিধ্বনি করেছেন এবং রাশিয়াকে ক্রিমিয়া এবং ডনবাস থেকে ঠেলে দেয়ার বিষয়ে বিস্তৃতভাবে কথা বলেছেন, অন্য কথায় ইউক্রেনকে তার ২০১৪-এর পূর্বের সীমানায় ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে।
কিন্তু দ্রাঘি, শলৎজ এবং ম্যাখোঁর মন্তব্য ইউক্রেনীয়, ব্রিটিশ এবং আমেরিকানরা যা বলছে তার সাথে সংঘাতমূলক বলে মনে হচ্ছে। যদিও পশ্চিম ইউরোপীয় নেতারা যুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তি ঘটুক এবং সবকিছু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসুক’ বলে চাচ্ছেন কিন্তু কিয়েভ, লন্ডন এবং ওয়াশিংটনের নেতারা যা দাবি করছেন তাতে আরও দীর্ঘ সংঘর্ষ এবং বৃহত্তর পশ্চিমা সম্পৃক্ততার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে ক্রেমলিনের কোনো কৌশল ছাড়াই, যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে যুদ্ধের লক্ষ্য নিয়ে বিভক্তি দেখা যাচ্ছে।
শোইগু এবং অস্টিনের মধ্যে আগের টেলিফোন কলটি ১৮ ফেব্রুয়ারি হয়েছিল। এর পরে দুই পক্ষের মধ্যে আর কোন আলোচনা হয়নি। তবে রাশিয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ইউরোপের মধ্যে মত-পার্থক্য দেখা দেয়ায় সে প্রচেষ্টা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। উল্টো, ইউক্রেনে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করে নিয়েছে রাশিয়া। এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সাথে আলোচনায় আগ্রহী হয় যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছিলেন, তাদের লক্ষ্য রাশিয়াকে আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে না দেয়া। তবে সমালোচনার মুখে সেই কথা তুলে নিতে বাধ্য হন বাইডেন। বর্তমানে ইউরোপের মধ্যে বিভেদ ও মধ্যপ্রচ্যে নুতন করে সঙ্কট দেখা দেয়ায় রাশিয়ার থেকে বেশি চাপে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সঙ্কটের সমাধান খুঁজতে পুতিনকে অনুরোধ শলৎজের : জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ শুক্রবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সাথে ফোনালাপের সময় দ্রুততম যুদ্ধবিরতি এবং ইউক্রেনের পরিস্থিতির একটি কূটনৈতিক সমাধানের জন্য অনুসন্ধানের আহ্বান জানান। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান খাদ্য সঙ্কটের জন্য মস্কোর দায়বদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি। জার্মান মন্ত্রিসভার মুখপাত্র স্টেফেন হেবেস্ট্রেট সাংবাদিকদের একথা জানিয়েছেন। ‘গুরুতর সামরিক পরিস্থিতি এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলাফলের আলোকে, বিশেষ করে মারিউপোলে, রাশিয়ান প্রেসিডেন্টের সাথে কথোপকথনে, চ্যান্সেলর একটি যুদ্ধবিরতি অর্জন, মানবিক পরিস্থিতির উন্নতি এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংঘাতের কূটনৈতিক সমাধানের জন্য অগ্রগতির উপর জোর দিয়েছিলেন,’ মুখপাত্র উল্লেখ করেছেন।
‘চ্যান্সেলর এবং রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট খাদ্য পণ্যগুলির সাথে বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করেছেন যা রাশিয়ার আক্রমণাত্মক যুদ্ধের কারণে বিশেষ করে খারাপ হয়েছে,’ তিনি বলেছিলেন, ‘চ্যান্সেলর পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে, রাশিয়া এই বিষয়ে একটি বিশেষ দায়িত্ব বহন করে।’ মুখপাত্র আরও বলেছেন যে, চ্যান্সেলর ‘দ্ব্যর্থহীনভাবে ইউক্রেনে নাৎসিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।’ তার মতে, ইউক্রেনে সংঘাত থামানোর প্রচেষ্টার বিষয়ে কথোপকথন ৭৫ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। ‘১১ মে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সাথে চ্যান্সেলরের ফোনালাপের পরে কথোপকথনটি হয়েছিল,’ তিনি যোগ করেছেন।
অবরোধে বিধ্বস্ত ইউক্রেনের অর্থনীতি : রাশিয়ার অবরোধের ফলে কঠোর অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে ইউক্রেন। যদিও কিয়েভ সরকার সরাসরি স্বীকার করছে না, তবে বিশ্বব্যাংক মনে করে, ২০২২ সালে ইউক্রেনের জিডিপি সম্ভবত ৪৫ শতাংশ সঙ্কুচিত হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, শুল্ক রাজস্ব, সরকারের ট্যাক্স নেয়ার একটি বড় অংশ, কম আমদানির কারণে থমকে গেছে। সামরিক বেতন একটি বোঝা, অর্থায়নের ফাঁক মেটাতে ইউক্রেন বিদেশী সাহায্যের জন্য লবিং করেছেন। কিন্তু তারা বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ঘাটতির বিপরীতে ইউক্রেনের জন্য মাত্র ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। ফলে রাশিয়া অবরোধ না তুললে, এ সঙ্কট মোকাবেলা তাদের পক্ষে খুব কঠিন হবে।
ইউক্রেনে সঙ্কটের কারণে গোটা বিশ্বে শস্য, রান্নার তেল, জ্বালানি ও সারের দাম অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গেছে। বিশেষ করে আফ্রিকায় খাদ্য সংকট আরও গভীর হতে পারে বলে জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার হামলা শুরুর পর থেকে কৃষ্ণ সাগরে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটার কারণে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে শস্য ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানি কার্যত থমকে গেছে। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক বলেছেন, শুধু ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরেই প্রায় আড়াই কোটি টন শস্য আটকে রয়েছে। তার মতে, গোটা বিশ্বে বিশেষ করে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের লাখ লাখ মানুষের জন্য সেই শস্য সরবরাহ অত্যন্ত জরুরি।
রুবেজনয়ের শিল্প এলাকা মুক্ত করেছে লুহানস্কের সেনা : ইউক্রেন থেকে স্বাধীন হওয়া লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিকের (এলপিআর) সেনা রুবেজনয়েতে একটি প্রধান রাসায়নিক শিল্প সুবিধা মুক্ত করেছে এবং সেখানে তল্লাশী অভিযান চালিয়েছে। লুহানস্ক পিপলস মিলিশিয়া এ তথ্য জানিয়েছে। মিলিশিয়াদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে আপলোড করা একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এলপিআর জনগণের মিলিশিয়া জারিয়া প্ল্যান্টকে মুক্ত করেছে।’ প্রকাশিত ভিডিও অনুসারে, প্ল্যান্টের মূল প্রবেশপথে রাশিয়ার পতাকা, এলপিআর, চেচেন প্রজাতন্ত্র এবং বিজয়ের লাল ব্যানার উত্তোলন করা হয়েছিল। পিপলস মিলিশিয়া বলেছে, প্লান্টটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অভিযানে অগ্রসর বাহিনীর কোনো ক্ষয়ক্ষতি করেনি।
এলপিআরের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইভান ফিলিপোনেঙ্কো বলেছেন যে, শিল্প অঞ্চলটি চিরুনি অভিযান চালানো হয়েছে। ইউক্রেনীয় সৈন্যরা শহরের একটি এলাকায় প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু প্রচেষ্টাটি বাতিল করা হয়েছিল। জারিয়া রাসায়নিক প্ল্যান্টের বয়স ১০০ বছর। এটি অ্যামোনাইট, ট্রিনিট্রোটোলুইন, জৈব সংশ্লেষণের পণ্য - সালফিউরিক এবং ডাইনিট্রোবেনজয়িক অ্যাসিড - পলিমার এবং অন্যান্য রাসায়নিক পণ্য সহ বিস্ফোরক তৈরি করে। গত ২০ এপ্রিল, চেচনিয়ার নেতা রমজান কাদিরভ বলেছিলেন যে, রুবেজনয়ে শহরটি রাশিয়ান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রুবেজনয়ের মুক্তিতে অংশ নিয়েছিল রাশিয়ান সামরিক ইউনিট, ডোনেৎস্ক জনগণের মিলিশিয়া এবং চেচনিয়ার যুদ্ধ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আখমতের কমান্ডোরা।
ইউক্রেনে জৈব অস্ত্রের তদন্তে জাতিসংঘকে আহ্বান রাশিয়ার : রাশিয়া আন্তর্জাতিক চুক্তির অংশ হিসাবে ইউক্রেনে রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি ও গবেষণা কার্যকলাপের তদন্ত পরিচালনার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে (ইউএনএসসি) উপকরণ জমা দিতে চায়। জাতিসংঘে রাশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া শুক্রবার ইউএনএসসি বৈঠকে বলেছিলেন যে, রাশিয়া ইউক্রেনে মার্কিন জৈব গবেষণা নিয়ে আলোচনা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। ‘আমরা ইতিমধ্যেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উপাদান তৈরি করেছি যা সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জৈবিক ও টক্সিন অস্ত্র কনভেনশনের লঙ্ঘনের দিকে নির্দেশ করে। আমরা এই উপকরণগুলো সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ চালিয়ে যাচ্ছি।’ সূত্র : তাস, পলিটিকো, দ্য ইকোনমিস্ট।
সম্পাদক:সাহিদুর রহমান
অফিস:২৭/১১/২, তোপখানা রোড, পল্টন মোড়,ঢাকা -১০০০।
ফোন: ০১৯১১- ৭৩৫৫৩৩ ই- মেইল : [email protected], [email protected]