এস,এম শাহাদৎ হোসাইন গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি, দৈনিকশিরোমিণিঃ গরম এলেই গ্রামেগঞ্জে বাড়ে হাতপাখার চাহিদা। হাতপাখা তৈরী করে স্বচ্ছলতা এসেছে গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার দেড় শতাধিক পরিবারে। গ্রামটি খ্যাতি পেয়েছে পাখার গ্রাম হিসেবে। বাড়ির উঠানে কেউ সুতা গোছাচ্ছেন, কেউ করছেন বাঁশ কাটার কাজ, আবার কেউবা ব্যস্ত পাখা বুননে। গৃহকর্ম শেষে অবসর সময়ে এসব হাতের কাজ করে পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতায় অবদান রাখছেন নারীরা। পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ কাজেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতামত দিচ্ছেন পরিবারের নারীরা। গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে জামালপুর ইউনিয়নের বুজরুক রসুলপুর গ্রামের খামারপাড়া এবং রসুলপুর ইউনিয়নের আরাজি ছান্দিয়াপুর গ্রাম। গ্রাম দু’টির দেড় শতাধিক পরিবার বাঁশের চাকের ভেতরে বিভিন্ন রঙের সুতো দিয়ে তৈরি করে হাতপাখা। মানুষের মুখে মুখে গ্রাম দুইটি পাখার গ্রাম হিসেবে পরিচিত। রান্না করার পাশাপাশি চলছে হাতপাখা তৈরির কাজ। আঙিনায় বিশ্রামের সময় গল্প করতে করতেও চলছে পাখার বুননের কাজ। অলস সময় না কাটিয়ে যখনই সময় পাচ্ছেন তখনই পাখা তৈরির কাজ করছেন। ১০ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত এ কাজের সঙ্গে জড়িত। সকালে গৃহস্থালির কাজ শেষ করে আঙিনায় বসে যায় নারীরা রঙিন সুতোয় পাখা তৈরীর কাজে। পুরুষরা কৃষি বা অন্য পেশায় যুক্ত থাকলেও পাখার হাতল, ডাটি, চাক তৈরিসহ বাঁশের কাজ করেন আর পাখা তৈরির মূল কাজটি করেন নারীরা। গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়বে পাখা তৈরির দৃশ্য। গাছের নিচে, পুকুরপাড়ে দু-তিনজন একসঙ্গে বসে গেছেন সুই-সুতো আর চাক নিয়ে। সোমেনা বেগম, মরিয়ম বিবি, হাসিনা বেগম, মাজেদা খাতুনের মতো অনেকেই পাখা তৈরী সবসময়। কোনো প্রশিক্ষণ নেই তাদের, নিজে নিজে শেখা তাদের এ কাজ। বড়দের দেখে স্কুল পড়–য়া মেয়েরাও হাত পাখায় কাজ করেছে। পাখা কারিগর সোমেনা বেগম বলেন, চৈত্র থেকে আশি^ন মাস পর্যন্ত পাখার বেচাকেনা চলে। দু’টি গ্রামের ৪শত পরিবারের মধ্যে দেড় শতাধিক পরিবার জড়িত হাতপাখা বুননের সঙ্গে। এসব পরিবারের নারীরা প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার হাতপাখা তৈরি করেন। হাতপাখা তৈরির পর কেউ কেউ গ্রামে গ্রামে বিক্রি করেন, আবার অনেকেই পাইকারের হাতে তুলে দেন। এ দুই গ্রামের হাতপাখা গাইবান্ধার বাহিরে চলে যায় জামালপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। মাজেদা খাতুন বলেন, স্বামী মাহে আলম কৃষি শ্রমিকের কাজ করতেন। তিনি ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালাতেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। ১০ বছর আগে তিনি হাতপাখা তৈরি শুরু করেন। হাতপাখা তৈরীর উপার্জিত অর্থ দিয়ে এক ছেলেকে বগুড়া শহরে রেখে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতি হিসেবে গয়না তৈরী করেছি, দুটি টিনের ঘর তুলেছি। মাহে আলম অন্যের জমিতে শ্রম বিক্রি ছেড়ে দিয়ে পাখা বিক্রি করেন। স্বামী আর দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভালোই আছেন তিনি। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা থেকে ৩০০ টাকা কেজিতে সুতা আনতে হয়। মোবাইল ফোনে চাহিদা জানালে সুতা বাড়িতেই পৌঁছে দেয়। এক কেজি সুতা দিয়ে ২৫ থেকে ৩০টি হাতপাখা বানানো যায়। প্রতিটি পাখা তৈরি করতে ১০ টাকার সুতো, দুই টাকার বাঁশের হাতল, তিন টাকার বাঁশের চাক, তিন টাকার সুতো মোড়ানোর কাপড় ও পারিশ্রমিকসহ প্রায় ২৫ টাকা খরচ হয়। হাতপাখার মান ভেদে ৩৫ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত একটি হাতপাখা বিক্রি হয়। দিনে ৮ থেকে ১০টি হাতপাখা একজনে তৈরী করতে পারে। পাইকাররা এসে বাড়ি থেকেই পাখা কিনে নিয়ে যায়। বছরের সাত থেকে আট মাস চলে পাখা তৈরির কাজ। তবে ফালগুন থেকে জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত চাহিদা থাকে বেশি। হাত পাখাকেই ঘিরে নির্বাহ হচ্ছে তাদের জীবন-জীবিকা। এ শিল্পের মাধ্যমে তাদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে।