রেজিঃ নং ডিএ ৬০০৯ | বর্ষ ১৪ | ৪ পৃষ্ঠা ৩ টাকা || সোমবার | ২৫ নভেম্বর ২০২৪ | ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
রেদোয়ান হাসান,সাভার,ঢাকা,দৈনিক শিরোমণিঃ
ছিলেন পাড়া গাঁয়ের শিক্ষার্থী। হেঁটে-খেয়া পার হয়ে যেতেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। গ্রামের আর ১০ জনের মতো ছিলো তার জীবন। কিন্তু এক ঝড়ে সেই হয়ে উঠেছিলো দেশের হটটপিক। হারাতে হয়েছিলো পা। জীবন যেনো থেমে গিয়েছিলো তার। তবে ঝড়ের পরেই আসে সুন্দর সকাল। হয়েছে তেমনই। বলছিলাম, র্যাবের গুলিতে পা হারানো ঝালকাঠির সাতুরিয়া গ্রামের সেই লিমন হোসেনের কথা।
জীবনযুদ্ধে লড়াইয়ের পর তিনি এখন একজন আইনজীবী ও শিক্ষক। সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী প্রভাষক তিনি। সাবলীল বাচনভঙ্গি ও সদাহাস্যজ্বল লিমন ক্যাম্পাস জুড়ে প্রিয়মুখ। চট করে বোঝার উপায় নেই এই জীবনে নেমে এসেছিলো কালো দিন। ১০ বছর আগে প্রত্যন্ত গ্রামের লিমনকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে পায়ে গুলি করেছিলো র্যাব সদস্যরা।
এরপর সরকারি কাজে বাঁধা ও অস্ত্র আইনে ২০১১ সালে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় দু'টি মামলা। পরে ২০১৩ সালে মামলা দুটি থেকে লিমনকে বাদ দেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ২০১১ সালেই লিমনের মা হেনোয়ারা বেগমও ঝালকাঠি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে র্যাবের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেছিলেন। কিন্তু নয় বছর পেরিয়ে গেলেও এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি।
লিমন হোসেনের সঙ্গে কথা বলেছে রাইজিং বিডি অনলাইন। সেইসব দিনের বিস্তারিত জানিয়েছেন তিনি। বলেন, ‘আমার মা হেনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে র্যাবের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে। যে মামলাটি আমাকে হত্যাচেষ্টার উদ্দেশ্যে গুলি করার। মামলাটি বর্তমানে বরিশাল পিবিআই এর কাছে তদন্তাধীন। আমি চাই একটা সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রতিবেদনটা প্রকাশ করা হোক। একটা সময় আমরা জুডিশিয়ারী বা বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছিলাম। সেটাতো আমরা পাইনি। র্যাব থেকে পিবিআইয়ের কাছে তদন্ত চাওয়া হয়েছিল। সেই মোতাবেক পিবিআইয়ের কাছেই মামলা তদন্তভার আছে। আসলে বাংলাদেশে একটি মামলা তদন্ত করতে কত দিন লাগে? এটা আমার জানা নাই। আমি চাই এটা যেন আলোর মুখ দেখে। সরকারের কাছে এটা আমার আকুল আবেদন।’
‘২০১১ সালে র্যাব যখন আমার পায়ে গুলি করে তখন আমার বয়স ছিল ১৬ বছর। একটা বাহিনীর সাথে ফাইট করার জন্য দেশের মানুষ ও সাংবাদিকদের একটা ভূমিকা ছিল। সবচেয়ে বড় সাহস ছিল আমার মা এবং আমার সৎ সাহস, যে আমি কখনো সন্ত্রাসী ছিলাম না। আমাকে সন্ত্রাসী প্রমাণ করতে পারবে না। র্যাব কেন পৃথিবীতে যদি ফেরেশতা এনেও তদন্ত করা হয় তাহলে খুব ভালো হবে। তাহলে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হবো। এখন পিবিআই যে তদন্ত করছে ওখানে নিশ্চয় আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি, আর র্যাব দোষী বলেই তদন্ত আলোর মুখ দেখছে না।’
ঝালকাঠি জেলা জজ কোর্টের আইনজীবী এ্যাডভোকেট আক্কাস শিকদার জানান, ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ প্রতিবেদনে লিমনকে র্যাব গুলি করে নাই উল্লেখ করায় ২০১৩ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে লিমনের মা জেলা জজ আদালতে রিভিশন করেন। পাঁচ জন বিচারক এই রিভিশনটা শোনেন নাই। একের পর এক টাইম পিটিশন মঞ্জুর করেছেন। ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল ৪২তম তারিখে একজন এ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট জজ এটা মঞ্জুর করেন। একই সালের ২২ এপ্রিল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে পুনরায় একজন বিসিএস কর্মকর্তাকে এই মামলার তদন্ত করার নির্দেশ দেন। বর্তমানে পিবিআইতে মামলাটি আটকে আছে।
এই আইনজীবী আরো জানান, আমাদের ধারণা এই মামলার যে সমস্ত ডকুমেন্ট আছে তাতে চার্জশিট হওয়ার কথা। তবে র্যাবের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়ার মতো সক্ষমতা বাংলাদেশে কোন এজেন্সির আছে কি না সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ র্যাবও পুলিশ, আর পিবিআইও পুলিশ। এখন সেখানে তারা কতটা তদন্ত করবে বা এই তদন্ত কর্মকর্তারা কোন ঝুঁকি নেবে কি না সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। যার কারণেই তারা তদন্তটা ঝুলিয়ে রেখেছে।
লিমন আরো জানান, ‘র্যাব যখন আমাকে গুলি করে ওই সময় আমার পা কেটে ফেলে। গুলি, হামলা, মামলা করেই শুধু এরা ক্ষান্ত হয়নি। একটা সময় এরা আমার পরিবার ও আত্মীয়দের উপরেও প্রচণ্ড চাপ দিতো। এমনকি এখনো র্যাবের কথিত সোর্স ইব্রাহিম আমার ভিটেমাটি দখল করে আছে।’
‘মানুষিক ভাবে আমি খুব একটা ভালো নেই। কারণ আমরা দীর্ঘ দিন ধরে দেশের বাড়িতে থাকি না। র্যাবের কথিত সোর্স ইব্রাহিম হাওলাদার এখন ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগ নেতা বনে গেছেন। তিনি ও তার লোকজন তাদের পৈতৃক ভিটেতে ঘর তুলতে দিচ্ছে না। চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ইব্রাহিমকে সাপোর্ট দিচ্ছেন। আমাদের স্থায়ী একটা থাকার জায়গা নাই। আমারা বাবা-মা এখন পার্শ্ববর্তী কাউখালী থানার একটি ভাড়া বাসায় থাকছেন।’
রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হেমায়েত হোসেন নুরু মিয়া বলেন, যে সময় র্যাব লিমনকে গুলি করে তখন ইব্রাহিম ও বর্তমান চেয়ারম্যান লিমনের বিপক্ষে কাজ করেছে। ইব্রাহিমতো ভালো লোক না। সে র্যাবের সোর্স হিসেবে কাজ করতো। বতর্মান চেয়ারম্যানের সাপোর্টেই সে এলাকায় নানা অপকর্ম করে আসছে। ছিদ্দিক চেয়ারম্যানও ডাকাতির মামলায় সাত বছর জেলে খেঁটেছেন।
এ ব্যাপারে সাতুরিয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছিদ্দিকুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মরণের মুখ থেকে ফিরে আসা লিমন হোসেন তার স্বপ্ন নিয়ে বলেন, ‘দেশে নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের আইন সহায়তা দিতে চাই। আমার একটা সময় ইচ্ছা ছিল আমি মানবাধিকার আইনজীবী হবো। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করাটাই আমার ইচ্ছা। আমার পাওয়ার কিছু নাই। আমি জীবনে সব পেয়েছি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে আমি নতুন করে একটা জীবন পেয়েছি। এ জন্যই সারা দেশের মানুষ ও সুশীল সমাজের মাধ্যমে নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াতে চাই।’