অনলাইন @সাগর উপকূলে কীটনাশক ছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত প্রাকৃতিক উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করা মুখরোচক শুঁটকি বিদেশে রফতানির সাথে সাথে চট্টগ্রামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অনলাইনে শুঁটকি বিক্রি। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে অনলাইনে অর্ডার করলেই গ্রাহকের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে হরেক রকম শুঁটকি। বিশেষ করে করোনার কারণে গত বছর থেকে অনলাইনে শুঁটকি বিক্রির চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
এ দিকে ২০২০-২১ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন হাজার ৮৯৩ মেট্রিক টন শুঁটকি রফতানি করে ৬৬ লাখ ৮৮ হাজার মার্কিন ডলার অর্জিত হয়েছে। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪ হাজার ২৭৫ মেট্রিক টন শুঁটকি রফতানি করে হয় আয় হয়েছিল ৮১ লাখ ৮৪ হাজার ডলারের। চলতি অর্থবছরের বাকি সময়ে আরো বিপুল পরিমাণ শুঁটকি রফতানি হবে প্রত্যাশা করছেন মৎস্য অধিদফতরে মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম।
জানা গেছে, শীত মৌসুম ছাড়াও দেশে এখন বছরজুড়ে প্রাকৃতিক উপায়ে রোদে ও বাতাসে শুকিয়ে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে। বিশেষ করে কক্সবাজারসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় গড়ে উঠেছে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ শেড। তারা বছরজুড়েই নানা রকম মুখরোচক শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করে আসছে।
২০২০ সালের মার্চ থেকে এই পর্যন্ত বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রকোপের কারণে শুঁটকি ব্যবসা অনেকটা গুটিয়ে এসেছিল। তবে পরবর্তী সময়ে প্রচুর পরিমাণ শুঁটকি রফতানি হওয়ায় সামগ্রিকভাবে ব্যবসাটি ঘুরে দাঁড়ায়।
জানা গেছে, বছরজুড়ে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হচ্ছে, তেমনি এ কাজ করে শত শত নারী-পুরুষও কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর উপকূলজুড়ে পশ্চিম পটিয়ার জুলধা, চর পাথরঘাটা, ইছানগর, ডাঙ্গার চর, খোয়াজ নগর, পটিয়ার শিকলবাহা, কালারপুল, বঙ্গোপসাগর উপকূলের আনোয়ারার রায়পুর, বাঁশখালীর শেখেরখীল, গণ্ডামারা, খানখানাবাদ, মহেশখালী, নাজিরার টেক, কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিনসহ চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপকূলের দুই শতাধিক স্পটে চলতি বছরে মৌসুমের শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের ধুম পড়েছে।
এসব এলাকায় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে রোদ ও বাতাসে শুকিয়ে ছুরি, লইট্যা, হাঙ্গর, ফাইস্যা, বাইল্যা, কোরাল, রূপচাঁদা, হাইছচাঁদা, চিংড়ি, লাক্ষা, তাইল্যা, ফাতারা, পোঁপা, মলা, চৈক্কা, চাপিলাসহ নানা প্রজাতির মাছ শুঁটকি হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ক্ষতিকারক কীটনাশক ও ডিটিটি ছাড়াই রোদ ও বাতাসে শুকিয়ে তৈরি করা শুঁটকির সুখ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। আর তাই এখন প্রতি বছর শত শত টন বিভিন্ন প্রজাতির শুঁটকি বিদেশে রফতানি করে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন হচ্ছে।
কর্ণফুলী উপকূলের পশ্চিম পটিয়ার চরপাথরঘাটা, ইছানগর ও ডাঙ্গার চর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শুঁটকি তৈরির বিভিন্ন কলাকৌশল। কেউ বাঁশের মাচাং তৈরি করে আবার কেউ মাটির ওপর পলিথিন বিছিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির কাঁচা মাছ ঝুলিয়ে ও বিছিয়ে রোদে শুকিয়ে নানা রকম শুঁটকি তৈরি করছে। এ কাজে থাকতে দেখা যায় শত শত নারী ও পুরুষ শ্রমিককে।
ইছানগর এলাকার শুঁটকি ব্যবসায়ী শেখ আহমদ গণমাধ্যমকে জানায়, তিনি ২০ বছর ধরে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত প্রাকৃতিক উপায়ে বিভিন্ন প্রজাতির শুঁটকি তৈরি করেন। তিনি জানান, এখানকার শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশে রফতানি করা হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, হংকং, চায়না ও তাইওয়ানের মতো দেশেও আমাদের দেশের শুঁটকির কদর রয়েছে।
পাইকারি শুঁটকি ব্যবসায়ী শুঁটকি বিতানের মালিক পারভেজ হুসাইন বলেন, গত বছর করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে অনলাইনে শুঁটকি বিক্রির শুরু করেন তিনি। এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অনলাইনে শুঁটকি বিক্রি। এখন তার মতো আরো অনেকেই অনলাইনে শুঁটকি বিক্রি শুরু করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও এখন ইউরোপ ও আমেরিকাতেও অনলাইনে শুঁটকি বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এ দিকে চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জসহ বিভিন্ন শুঁটকি বাজারে গতকাল পর্যন্ত প্রকার ভেদে প্রতি কেজি ছুরি ১০০০/১১০০ টাকা, লইট্যা ৪০০ টাকা, কোরাল ১৬০০/১৭০০ টাকা, লাক্ষা ৩৩০০/৩৪০০ টাকা, রূপচাঁদা ৩৩০০/৩৫০০ টাকা, পোয়া ৬০০/৮০০ টাকা, তাইর্যা ২২০০/২৩০০ টাকা, চৈইক্যা ৪৫০/৫০০ টাকা, চাপিলা ২৫০/৩০০ টাকা, মলা ৪২০/৪৫০ টাকা, ফাসিয়া ৫০০/৬০০ টাকা, চিংড়ি ১৫০০/১৬০০ টাকা, হাইচ চাদা ১২০০/১৩০০ টাকা, ফাতরা বা সাদা পাতা ৮০০/৭০০ টাকা ও বড় ছোট হাঙ্গর শুঁটকি পাইকারি বিক্রি হয়েছে ৩০০/৭০০ টাকা করে বলে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী জানিয়েছেন উপজেলা পর্যায়ে উপকূলীয় যেসব এলাকায় শুঁটকি তৈরি করা হয়, সেখানে তদারকি করা হচ্ছে এবং শুঁটকি তৈরির কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। ফলে বর্তমানে এসব এলাকায় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে বিষমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত বিভিন্ন প্রজাতির শুঁটকি তৈরি হচ্ছে। তিনি জানান, করোনা কালেও দেশে শুঁটকি উৎপাদন থেমে নেই। তিনি গত মৌসুমের চেয়ে চলতি মৌসুমে আরো বেশি পরিমাণ শুঁটকি বিদেশে রফতানি হওয়ার প্রত্যাশা করেন।