বিদেশ @দারিদ্র্যতা নিরসনে চীন প্রতিষ্ঠিত ‘সমবায় উন্নয়ন সেন্টার’কে ‘বিকল্প সার্ক’ হিসেবে ভাবছেন বিশ্লেষকরা। বেইজিংয়ের ওই উদ্যোগে বাংলাদেশ সহ সার্কের ৫ সদস্য রাষ্ট্রের তাৎক্ষণিক সমর্থনকে এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। যদিও বেইজিং সেন্টারে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের অংশগ্রহণের বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। তাছাড়া এখনো ওই উদ্যোগের বাইরে রয়েছে ভুটান এবং মালদ্বীপ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সহ ঢাকার দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশকে চীন এমন ধারণা দিয়েছে যে, এতে তারা একান্তভাবে ভারতের অংশগ্রহণ চাইছে। এ জন্য ভারতকে অত্যন্ত খোলা মনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে চীন। দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্যতা নিরসন সংক্রান্ত চীনের উন্নয়ন সেন্টার প্রতিষ্ঠা, যাকে বিশ্লেষকরা মৃতপ্রায় সার্কের বিকল্প হিসেবে ভাবছেন- সে সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন গতকাল মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশ এমনটি মনে করছে না। কারণ এটি চীনের একটি নির্ভেজাল উদ্যোগ।
যার সঙ্গে শুরু থেকেই বাংলাদেশ রয়েছে। ওই সেন্টার প্রধানত দু’টি কাজ করবে। প্রথমত: বাংলাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা ভ্যাকসিনের যোগান নির্বিঘ্ন রাখা। দ্বিতীয়ত: এ অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের জীবন রক্ষা। দারিদ্র্যতা থেকে দেশের মানুষকে বের করে আনার ক্ষেত্রে চীন গোটা বিশ্বে অনন্য মডেল- এমন মন্তব্য করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আপাতত ভারত বাইরে থাকলেও বেইজিং আশা করে শেষ পর্যন্ত তারা এতে যুক্ত হবে। মন্ত্রীর মতে, ভারতকে বাদ দিয়ে নয় বরং দক্ষিণ এশিয়ার সব রাষ্ট্রকে নিয়েই চীন সেন্টারটির পূর্ণতা দিতে চায়। বাকি রাষ্ট্রগুলো যেকোনো সময় যোগ দিতে পারবে। তাদের যোগদানে কোনো রকম পূর্ব শর্ত বা বাধা নেই। ওই সেন্টার প্রশ্নে ঢাকা বা বেইজিংয়ের ভাষ্য যাই হোক না কেন- দক্ষিণ এশীয় বিশ্লেষকরা এটাকে ভূ-রাজনীতির খেলা হিসেবে দেখছেন। নেপালের দুই প্রধানমন্ত্রীর সাবেক পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ও জাতিসংঘে দায়িত্ব পালনকারী রাষ্ট্রদূত দিনে ভট্টারাই’র মতে, যদি দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য নির্মূলই বেইজিং সেন্টারের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হয়, তাহলে কেন ভারতকে বাইরে রাখা হয়েছে? দেশটিতে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ রয়েছে, যা সাব-সাহারা অঞ্চলের দারিদ্র্যতার সমান- এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমি ওই সেন্টার প্রতিষ্ঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-কৌশলগত তাৎপর্য ও অর্থ রয়েছে বলে মনে করি। নেপালে চায়না স্টাডি সেন্টারের চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত সুন্দরনাথ ভট্টারাই’র মতে, এটি যে চীনের নেতৃত্বে ‘মাইনাস ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ, তা স্পষ্ট। দক্ষিণ এশীয় যেসব দেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই’র সমর্থক তারাই মূলত ওই সেন্টারের অংশীদার। যদিও এখনো বাইরে রয়েছে মালদ্বীপ। কিন্তু তারাও শেষ পর্যন্ত এতে যুক্ত হবে, কারণ মালে বিআরআই’র সঙ্গে রয়েছে। গত এপ্রিলে বেইজিং সেন্টার গড়ে তোলার ধারণা প্রথম তুলে ধরা হয় দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র ভার্চ্যুয়াল মিটিংয়ে। করোনা মোকাবিলায় পারস্পরিক সহযোগিতা বিষয়ে আলোচনার জন্য বৈঠকটি আহ্বান করেছিল চীন। এতে ভারতকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু দেশটি অংশগ্রহণ করেনি। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি মতে, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ওই ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে চীনের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েং ই প্রথম দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে নিয়ে চীনের দারিদ্র্য নির্মূল ও সমবায় উন্নয়ন সেন্টার গড়ে তোলার প্রস্তাব করেন। সেখানে বিস্তারিত আলোচনার পর অংশগ্রহণকারী দক্ষিণ এশীয় ৫ রাষ্ট্র তাৎক্ষণিক উদ্যোগটিকে স্বাগত জানায়। মে এবং জুনে এ নিয়ে দ্বিপক্ষীয়ভাবে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। যার অগ্রগতি দৃশ্যমান হয় গত বৃহস্পতিবারে চীনের চংকিং শহরে দারিদ্র্য নির্মূল ও সমবায় উন্নয়ন সেন্টারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে। ফিজিক্যাল ওই উদ্বোধনীতে সেন্টারটির সমর্থক বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় ৫ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হাজির ছিলেন। তারা একটি গ্রুপ ফটোসেশনেও অংশ নেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রায় কোমায় থাকা দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা সার্ক-এর আট সদস্য রাষ্ট্রের পাঁচটি আচমকা বেইজিংয়ের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়নি। ভারত-পাকিস্তান বৈরিতায় সার্ক প্রক্রিয়া স্তিমিত হয়ে পড়া সুযোগটি এখানে কাজে লাগিয়েছে বেইজিং। এ জন্য তারা ভারতকে বাইরে রেখে উদ্যোগটি এগিয়ে নিয়েছে। তাদের লক্ষ্য ভারতকে মোকাবিলা এবং অঞ্চলটিতে চীনের উপস্থিতি শক্তিশালী করা। যার গুরুত্বপূর্ণ ভূ-কৌশলগত তাৎপর্য রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনা উদ্যোগটি এমন সময় গতি পেয়েছে যখন ভারতও সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টার পাশাপাশি বিমসটেককে নিয়ে সক্রিয় রয়েছে। নয়াদিল্লিভিত্তিক মনোহর পারিকার ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস-এর রিসার্চ ফেলো নিহার নায়ক মনে করেন- চীন দক্ষিণ এশিয়াকে টার্গেট করেছে এবং সার্কের পাল্টা সংস্থা গড়ে তুলতে চাইছে। তাই দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন উদ্যোগের নামে তারা সংযুক্ত হচ্ছে। পাকিস্তান বরাবরই চীনের বন্ধু। যেকোনো উদ্যোগে তারা ইসলামাবাদকে পাশে পাবে- এটা ধরে নেয়াই যায়। কিন্তু যেভাবে চীন প্রথমে আফগানিস্তান এবং পরে বাংলাদেশকে নিশানায় রেখেছে- সেটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ওই দুই দেশের পরেই নেপালের পালা আসবে বলে মনে করে ওই বিশ্লেষক। নেপালের সাবেক উপদেষ্টা ভট্টারাই অবশ্য মনে করেন- সার্কের আজকের অবস্থান চীনের এই নতুন উদ্যোগে গতি এনেছে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়, চীনের মুখ্য উদ্দেশ্যে আমেরিকাকে মোকাবিলা। তাই তাদের নেতৃত্বাধীন দক্ষিণ এশীয় ব্লকটি এমনও হতে পারে যে, এটি ওয়াশিংটন নেতৃত্বাধীন কোয়াডের বিকল্প। তার মতে, বৃহত্তর অর্থে চীন হয়তো ‘হিমালয়ান কোয়াড’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছে!