বিল্লাল হোসেন সোহাগ, শেরপুর প্রতিনিধি:১৫ থেকে ২০ শতক যায়গার উপর একটি খেলার মাঠ। তার বাইরে দাড়িয়ে আছে দুইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও একটি ধর্মীয় স্থাপনা (মাজার)। এতটুকু যায়গার উপর ঠিক মরার উপর খরার ঘা হয়ে দাড়িয়ে আছে সাধারন মানুষের যাতায়াতের জন্য ৮ ফিট প্রশস্তের একটি পাকা রাস্তা। এ যেন শহরের এক গলি পথ। শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার কুড়িকাহনিয়া বাজারের পাশেই ইংজের আমলে (১৯৩৮ সাল) প্রতিষ্ঠিত ঐতিয্যবাহী কুড়িকাহনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কুড়িকাহনিয়া সাউথ কুরুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের চিত্র এটা। দুইটি প্রতিষ্ঠানের একর একর যায়গা থাকার পরও মালিকানা দ্বন্দের ফেরে বর্তমান মাঠ এখন ৩ থেকে ৪ কাঠায় পৌছেঁছে। এতে কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীরা তাদের একমাত্র খেলার মাঠে আর খেলতে পারছে না। খেলাধুলার অভাবে শিশুরা অমনযোগী হয়ে পড়ছে পড়াশুনায়। হীনমোন্যতায় ভোগার পাশাপাশি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ। মাঠের অভাবে শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে বিদ্যালয়ে খেলাধুলার অধিকার থেকে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভালোভাবে গড়ে তুলার জন্যে খেলার মাঠ তৈরির দাবি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের।নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক জানান, মাঠের অভাবে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব হয় না। টিফিন কিংবা অন্য বিরতির সময় তারা শ্রেণিকক্ষে বসেই সময় পার করে। ফলে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মাঠের অভাবে শারীরিক কসরত ও খেলাধুলা করার সুযোগ হতে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ফলে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হচ্ছে না কোমলমতি শিশুদের মেধা। মাঠের অভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকরা পরিচালনা করতে পারে না সহশিক্ষা কার্যক্রম। বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে শ্রেণিকক্ষে জাতীয় সঙ্গীত-শপথ বাক্য পাঠ করানো হলেও খেলাধুলা ও শরীর চর্চা হয়না। এতে করে অন্যান্য বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়ে সহশিক্ষা কার্যক্রমে পিছিয়ে পড়ছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।স্থানীয় বাসিন্দা ও অভিভাবকরা বলেন, শিক্ষার্থীদের খেলার মাঠ দখল করে রাস্তা নির্মানের ফলে স্কুলের মাঠ ছোট হয়ে এসেছে। স্কুলের সামনে পাকা রাস্তার তৈরিতে শিশু শিক্ষার্থীরা দুর্ঘটনার কবলে পড়বে এমন আশঙ্কা করছেন অনেক অভিভাবক। তাদের দাবি, সড়ক হোক স্কুলের দক্ষিণ দিক দিয়ে, মাঠের ভিতর দিয়ে নয়। বেশ কয়েকজন অভিভাবক বলেন, রাস্তা পাকা করার সময় স্থানীয় জনগন বাধা দিলে মাঠের উপর রাস্তা নির্মান বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকে। তবে অদৃশ্য কালো হাতের থাবায় আবার তৈরি হয় মাঠের উপর দিয়ে রাস্তা। স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার মো. মুস্তফা বলেন, দুই স্কুলের মাঝ দিয়ে সব সময় গাড়ী যাতায়াত করায় যে কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, আমার দুইটা বাচ্চা ওই স্কুলে পড়াশুনা করে। মাঝখান দিয়ে রাস্তা থাকায় আমি সব সময় চিন্তিত থাকি কখন যেন আমার বাচ্চা গুলো দুর্ঘটনার কবলে পরে।এ বিষয়ে কুড়িকাহনিয়া সাউথ কুরুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রিয়া ইসলাম বলেন, মাঠ না থাকায় আমরা বিদ্যালয়ে এসে কোনো প্রকার খেলাধুলা ও শরীর চর্চা করতে পারি না। এতে আমাদের পড়াশুনায় মন বসে না। টিফিন হলে ক্লাসে বসি থাকি। ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র মিনাল মিয়া বলেন, ক্লাস চলাকালিন সময়ে রাস্তা দিয়ে ট্রলি, অটোরিক্সা, মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য গাড়ির শব্দে স্যারের কথা ভালো ভাবে বুঝতে পারিনা। অনেক সময় উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে স্কুলের মাঠ দিয়ে গাড়ি যাতায়াত করায় আমাদের পড়ালেখার সমস্যা হয়। ৮ম শ্রেণী ছাত্র রায়হান মিয়া বলেন, আমরা যখন সকালে প্যারেড করি তখন দুইপাশে গাড়ি জমে যায় যার জন্য স্কুলে এখন পিটি-প্যারেড হয়না।উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রশিদ জানান, ঘটনাটি স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিকে অবগত করা হয়েছে। সড়ক নির্মাণ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার বিঘ্ন ঘটাসহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি এবং বিদ্যালয়ের সৌন্দর্যও নষ্ট হয়েছে বলেও তিনি স্বীকার করেন। এছাড়াও রাস্তাটি তৈরির সময় তিনি দ্বায়িত্বে ছিলেন না বলেও জানান।এ ব্যাপারে কুড়িকাহনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মর্জিনা খাতুন মুঠোফোনে বলেন, মাঠের অভাবে বিদ্যালয়ে পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিয়ে সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা ব্যহত হচ্ছে। এমনকি আমাদের বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও করতে হয় দায়সারা ভাবে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মাঠে যা মোটেও কাম্য নয় এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে স্কুলের মাঠ তৈরিসহ রাস্তা অপসারনের জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্শন করেন।স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি (এডহক) মো. জিয়াউর রহমান মানিক বলেন, এই রাস্তাটি আমার দ্বায়িত্ব গ্রহনের আগে তৈরি করা হয়েছে। তবে কোমমতি এই শিশুদের খেলার মাঠ দেয়া আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই সময় স্থানীয় প্রভাবশালীদের মধ্যস্থতায় রাস্তাটি তৈরি করা হয়েছে বিধায় সাধারন জনগনের বাধা দেয়ার মতো পরিবেশ ছিলোনা। তবে স্কুলের জন্য নতুনভাবে ৪তলা বিশিষ্ট নতুন ভবন তৈরি হওয়ায় পুরাতন ভবন ভেঙ্গে মাঠ তৈরি করা যেতে পারে এবং মাঠের মাঝখান থেকে রাস্তা সরিয়ে মাঠের শেষ প্রান্তে দিয়ে দেয়াল তৈরি করে স্কুলকে নিরাপদ করা যেতে পারে।স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরুজ খান নুন বলেন, দুইটি স্কুল এক সাথে হওয়ার পরেও স্কুলের মাঠ আগে থেকেই ছোট। আবার দুইটি স্কুলেরই নতুন করে আলাদা আলাদা ভবন তৈরি করে মাঠকে আরও ছোট করা হয়েছে তার উপর আবার পাকা রাস্তা। এতে ছেলে-মেয়েরা সহশিক্ষার অংশ হিসেবে, পিটি প্যারেড, শারীরিক কসরত ও খেলাধুলা করতে পারছেনা। তবে সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের পুরাতন বিল্ডিং ও বিএডিসির একটি পরিত্যক্ত ভবন ভেঙ্গে স্কুলের পিছন দিয়ে একটি বিকল্প রাস্তা তৈরি করে শিশুদের নিরাপদ করা যেতে পারে বলেও তিনি যানান।উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার মোশারফ হোসাইন শিশুদের সমস্যা ও ঝুকির কথা স্বীকার করে বলেন, আমরা বিষয়টি আগেই অবগত হয়েছি এবং এ ব্যাপারে আমরা উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবগত করবো এবং বিষয়টি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে জানানোও হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই আমাদের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ থাকুক। এর জন্য তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা কামনা করেন। এব্যাপারে শ্রীবরদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডিএম শহিদুল ইসলাম বলেন, এ রাস্তা দিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ চলাচল করে এবং ম্যাপে রাস্তা থাকায় আমরা চাইলেও সেই সময় রাস্তা তৈরিতে বাধা দিতে পারিনি। তবে রাস্তা পাকাকরণের ফলে শিক্ষার্থীদের সমস্যা হচ্ছে বলেও তিনি স্বীকার করেন। তবে পুরাতন বিল্ডিং ভেঙ্গে মাঠ বড় করে মাঠের মাঝখান থেকে রাস্তা সরাতে সহযোগীতার কথাও তিনি বলেন। তিনি আরও বলেন, সরকারী স্থাপনা ভাঙ্গার একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন রয়েছে। আমরা বিষয়টি আলোচনা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা গ্রহন করবো।