আগামী জুনে চালু হবে পদ্মা সেতু; কিন্তু এতে ট্রেন চলবে তারও অন্তত বছর দেড়েক পর। আগামী জুলাইয়ে সেতুর নিচতলায় (লোয়ার ডেক) রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু করা যাবে। এতে অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে। তবে সেতু চালুর পর যানবাহনের চলাচলে সৃষ্ট কম্পনে রেললাইন স্থাপনে সমস্যা হবে কিনা- এ প্রশ্নের এখনও সমাধান হয়নি
সমস্যা না হলেও রেল সংযোগের কাজ পিছিয়ে থাকায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের আগে পদ্মা সেতুতে ট্রেন চালানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে রেল সূত্র। ট্রেন চলাচলের সময় দুর্ঘটনা ঘটলে যাত্রীদের নিরাপদ নির্গমনে সেতু এলাকায় চারটি স্থানে সিঁড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল রেলওয়ে। তবে সেতু বিভাগ এ পরিকল্পনাকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আখ্যা দিয়ে দুটি সিঁড়ি নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে।
দ্বিতল পদ্মা সেতুর ওপরতলায় (আপার ডেক) চার লেনের সড়কে চলবে গাড়ি। নিচতলায় সিঙ্গেল লাইনে চলবে ট্রেন। ২০২০ সালের ডিসেম্বর সবকটি স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে পূর্ণ আকার পেয়েছে পদ্মা সেতু। ওপরতলায় সড়ক নির্মাণ ও নিচে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের কাজ চলমান থাকায় রেল ট্র্যাক বসানোর কাজের অনুমতি এখনও পায়নি রেলওয়ে।
২০২০ সাল থেকেই সেতুতে রেল ট্র্যাক স্থাপনের অনুমতি চেয়ে আসছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেতুর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনুমতি দেওয়া সম্ভব নয়- এ যুক্তিতে অনুরোধ নাকচ করে এসেছে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)।
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির (এমবিইসি) বরাতে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম এক চিঠিতে রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক মো. আফজাল হোসেনকে জানান, জুনে গ্যাস পাইপলাইন এবং রেললাইন ওয়াকওয়ের সাপোর্ট বিম ও গ্রাটিং প্যানেল স্থাপনের কাজ শেষ হবে। আগামী ১ জুলাই থেকে রেল ট্র্যাক বসানোর কাজ শুরু করা যেতে পারে। তবে তা নির্ভর করছে পাইপলাইনের হাইড্রোলিক পরীক্ষার ওপর। আগামী এপ্রিলে এ পরীক্ষা শেষ হতে পারে। তখনই চূড়ান্তভাবে বলা যাবে, কবে নাগাদ রেললাইন স্থাপনের জন্য রেল সংযোগ প্রকল্পের ঠিকাদার চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের (সিআরইসি) কাছে সেতু হস্তান্তর করা যাবে।
গত বছরের জানুয়ারিতে রেল সংযোগ প্রকল্প থেকে এক চিঠিতে জানানো হয়েছিল, সেতুতে চলাচল শুরু হলে কম্পনে রেললাইন স্থাপনের কাজ বিঘ্নিত হতে পারে। সেতু প্রকল্পের পরিচালক চিঠিতে জানিয়েছেন, কম্পনের বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির উপস্থিতিতে সেতুর নকশা করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান এইসিওএমর সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন নেই। তবে কম্পনের কারণে রেললাইন স্থাপনের কাজ বিঘ্নিত হবে না বলে আলোচনায় অভিমত এসেছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া জানিয়েছেন, কম্পনে সমস্যা হবে- এমন অভিমত পাওয়া যায়নি।
রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক আফজাল সমকালকে বলেন, সেতু বিভাগ বলেছে, কম্পনের কারণে সমস্যা হবে না। সেতুতে রেলপথ হবে পাথরবিহীন। এ কাজে অন্তত ছয় মাস লাগবে। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে আরও বছর দেড়েক লাগতে পারে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পদ্মা সেতুতে ট্রেন চালানোর লক্ষ্যে কাজ চলছে।
যদিও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা ছিল, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সেতুতে গাড়ি সঙ্গে ট্রেনও চলবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের মেয়াদ দুই দফা বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুনে কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সেতু প্রকল্পের পরিচালক জানিয়েছেন, জুনের মধ্যেই কাজ শেষ হবে। তবে সেতু কবে নাগাদ চালু হবে, তার দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। সেতুর কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রেললাইন স্থাপনের জন্য সেতু হস্তান্তর করা হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, দেরি হওয়ার ঘটনা ইচ্ছাকৃত নয়।
বিবিএ পৃথক চিঠিতে জানিয়েছে, পদ্মা সেতুতে কখনও ট্রেন দুর্ঘটনা হলে যাত্রীদের জরুরি নির্গমনে সেতুর মাওয়া প্রান্তে রেলের ভায়াডাক্টের ৩৮ নম্বর নম্বর পিলারের কাছে সিঁড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। এখান থেকে সেতুর প্রথম পিলারের দূরত্ব এক হাজার ৭১০ মিটার বা প্রায় পৌনে দুই কিলোমিটার দূরে। জাজিরা প্রান্তে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি সেতুর শেষ পিলার থেকে ৯৯০ মিটার দূরে। এতে আপত্তি না তুললেও সেতু বিভাগের চিঠিতে দুর্ঘটনাকালের জন্য নির্মিত জরুরি বহির্গমন সিঁড়িকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলেছে বিবিএ।
প্রথম ও শেষ পিলারের কাছে সেতু বিভাগ জরুরি বহির্নির্গমন সিঁড়ি নির্মাণ করেছে। রেল সংযোগ প্রকল্প থেকে জানানো হয়, জাজিরা প্রান্তে রেলের ভায়াডাক্টের ২০ নম্বর পিলারের কাছে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি নির্মাণ চলছে। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে রেলের ভায়াডাক্টের দৈর্ঘ্য প্রায় চার ও আড়াই কিলোমিটার। এ অংশে দুর্ঘটনাকালে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি রাখা প্রয়োজন। রেলের প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, চারটি বহির্গমন সিঁড়ি থাকলে, জরুরি পরিস্থিতির উদ্ভব হলে যাত্রীরা দ্রুত বের হতে পারতেন। তবে সেতু বিভাগ দুটি সিঁড়ি নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে।
পদ্মা সেতু এবং রেল সংযোগ প্রকল্পে ‘সংঘাত’ আগে থেকে চলছে। পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তেই সংযোগ সড়ক থেকে যানবাহন ওঠার পথে রেলের ভায়াডাক্টের উচ্চতা এবং প্রশস্ততা নকশার চেয়ে কম থাকায় কাজ আটকে যায়।
চীনের ঋণ পেতে দেরি হওয়ায় সেতুর তুলনায় দেরিতে শুরু হয় রেল সংযোগের কাজ। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার পদ্মা সেতু এবং ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকার পদ্মা সেতু রেল সংযোগ- দুটি প্রকল্পই সরকারের অগ্রাধিকারের।
প্রথম প্রকল্পে মাওয়া-জাজিরায় পদ্মা নদীর ওপর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণ চলছে। দ্বিতীয় প্রকল্পে ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জ, পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কাজ চলছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে জানুয়ারি পর্যন্ত অগ্রগতি প্রায় ৯২ শতাংশ। রেল সংযোগ প্রকল্পে অগ্রগতি ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ। রেলের পরিকল্পনা ছিল, সেতু চালুর দিনেই ট্রেন চালাতে মাওয়া থেকে ভাঙা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজ আগেভাগে শেষ করার। সে লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায়, এখন পরিকল্পনা থেকে ঢাকা থেকে ভাঙা সেকশন একসঙ্গে চালু করা হবে।
ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ৪৯ শতাংশ। মাওয়া থেকে ভাঙ্গা অংশে অগ্রগতি ৭৬ শতাংশ। ভাঙ্গা থেকে যশোর অংশে নির্মাণের কাজ হয়েছে ৪৪ শতাংশ। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুনে যশোর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে। যদিও লক্ষ্যমাত্রায় পিছিয়ে রয়েছে প্রকল্পটি।