ইউক্রেনের কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর মারিউপোলের পতনের পর থেকে আজভ সাগরের পুরো উপকুল এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। খেরসন বন্দরসহ পুরো খেরসন এলাকা এবং জাপোরোৎযিয়া এলাকার বিশাল অংশও এখন রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে- যেগুলো অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।ইউক্রেন এবং তার পশ্চিমা মিত্রদের অনেকের মধ্যেই এখন এমন ধারণা জোরদার হচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট পুতিন যদি সহজে পুরো ডনবাস দখল করতে পারেন – তাহলে তিনি সেখানেই হয়তো থামবেন না।হয়তো তিনি ইউক্রেনের আরো এলাকা দখলের পথে যাবেন – যাতে ভবিষ্যতে কোনো আলোচনা হলে তা তার শর্ত মেনেই হয়।সম্প্রতি একজন রুশ জেনারেল খোলাখুলিই বলেছেন- মিকোলাইভ এবং ওডেসা হয়ে রোমানিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে চান তারা, যাতে মলদোভার রুশ অধ্যুষিত ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার সাথে রাশিয়ার একটি স্থল করিডোর তৈরি হতে পারে।তার অর্থ, আজভ সাগরের পর কৃষ্ণসাগর থেকেও ইউক্রেনকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা আঁটছে রাশিয়া।’পূরো (কৃষ্ণসাগর) উপকূল দখল করে ইউক্রেনের অর্থনীতিকে চরম চাপে ফেলার পথ নিতে পারে রাশিয়া, যাতে সাগর পথে ইউক্রেনের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়,’ আল জাজিরা টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন মিলান-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইতালিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিটিক্যাল স্টাডিজের গবেষক এলেনোরা আমব্রেসেটি।এই পথে রাশিয়া এগুবে কি-না, তা অনেকটাই নির্ভর করবে ডনবাস দখলের যুদ্ধে তাদের হারজিতের ওপর।
ইউক্রেনীয় বাহিনী কি মনোবল হারিয়ে ফেলছে?
নিউ ইয়র্ক টাইমসে এক নিবন্ধে বিশ্লেষক টমাস গিবন্স-নেফ লিখছেন, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী রুশ আর্টিলারি বা কামানের গোলাবর্ষণের প্রচণ্ডতার মুখে টিকতে পারছে না। তাদের প্রচুর সৈন্য নিহত হচ্ছে, নতুন যোগ দেয়া সৈন্য দিয়ে লড়াই চালাতে হচ্ছে এবং মানসিকভাবেও তারা বিপর্যস্ত,ইউক্রেনীয় ও পশ্চিমা গোয়েন্দা সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী- প্রতিদিন ইউক্রেনীয় পক্ষে শত শত সৈন্য নিহত হচ্ছে।রুশ বাহিনীতেও মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে একই মাত্রায়- কিন্তু তারা ধীরগতিতে হলেও যুদ্ধে অগ্রগতি ঘটাচ্ছে।কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের সামনের সারিতে থাকা ইউক্রেনীয় সেনাদলগুলো দীর্ঘ লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ার কারণে তারা ক্রমশই স্বল্প-প্রশিক্ষিত সৈন্যের ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে- যারা আসছে আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা দল বা ন্যাশনাল গার্ড থেকে।অন্যদিকে রুশ বাহিনীর ‘রিইনফোর্সমেন্ট’ আসছে ওয়াগনার প্যারামিলিটারি, মস্কো-সমর্থক চেচেন বাহিনী, এবং লুহানস্ক ও দোনেৎস্কের বিচ্ছিন্নতাবাদী যোদ্ধাদের মধ্যে থেকে।সৈন্যদের মধ্যে মনোবল কমে যাচ্ছে এমন খবর প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে দু’পক্ষই তৎপর।ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য সমস্যা হচ্ছে রুশদের হাতে গোলাবারুদ অনেক বেশি। একজন ইউক্রেনীয় জেনারেলের কথায়, ‘গোলাবারুদ একটা সমস্যা। আমরা একটি গুলি ছুঁড়লে ওরা ৫০টা গুলি ছোঁড়ে। আপনি এখানে কিভাবে লড়াই করবেন?’
ঘেরাও হওয়া ঠেকানো
ইউক্রেনের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের সৈন্যদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যেটি তা হলো- ঘেরাও হয়ে পড়া ঠেকানো, যেমনটা মারিউপোলে হয়েছিল।এটা ঠিক যে মারিউপোলে ইউক্রেনীয় বাহিনী যেভাবে যুদ্ধ করেছিল তাতে রাশিয়ার অগ্রাভিযানের গতি কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত পিছিয়ে গিয়েছিল । কিন্তু সবশেষ ফলাফল ছিল এটাই যে সেখানে ইউক্রেনীয় বাহিনীর সবচেয়ে দক্ষ সৈন্যরা হাজারে হাজারে নিহত বা বন্দী হয়েছিল। ইউক্রেন এখন সর্বোতভাবে চাইছে যেন এমনটা আর না হয়।প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তার ভাষণে এটা বলতে কোনো রাখঢাক করেননি।তিনি বলেছেন, ‘আমরা আবার দেয়াল গড়ে তুলব, ভূমি পুনরুদ্ধার করব কিন্তু সবকিছুর ওপরে লোকের জীবন বাঁচাতে হবে।’বিবিসির জো ইনউডকে ঠিকই একই কথা বলছিলেন সেরহি হাইদাই।’আমাদের সৈন্যরা পিছিয়ে এমন জায়গায় চলে গেছে যেখানে তাদের অবস্থান সুরক্ষিত। আমরা পাঁচ মাস ধরে লুহানস্ককে রক্ষা করেছি। যতদিন এই সুরক্ষা ছিল তার মধ্যেই আমরা দোনেৎস্ক অঞ্চলে নতুন প্রতিরক্ষাব্যুহ নির্মাণ করছিলাম। সৈন্যরা এখন সেখানেই চলে গেছে।’লিসিচানস্ক ও সেভেরোদোনেৎস্ককে যেভাবে ইউক্রেনীয় বাহিনী এতদিন রক্ষা করেছে তাকে এমনকি একটি “সফল সামরিক অপারেশন” বলেও আখ্যায়িত করেছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির উপদেষ্টা ওলেক্সি আরেস্টোভিচ।এ দুটি শহরেই এখন রুশ পতাকা উড়ছে। তাই এসব কথা শুনতে একটু অদ্ভূত শোনাতে পারে। কিন্তু ইউক্রেন যেটা বলার চেষ্টা করছে তা হলো, তারা একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে নেমেছে এবং এখানে যে সময় দরকার- সেটা হাতে রাখছে।এই যুক্তিটা বুঝতে হলে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে ইউক্রেনের অস্ত্র পাবার গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। সহজ কথায়, নেটোর সরবরাহকৃত অস্ত্র ছাড়া ইউক্রেন এখন যে অবস্থায় আছে তার চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থায় থাকত।রাশিয়ার অগ্রাভিযানকে তারা যত বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে – ততই তারা নিজেদের হাতে আরো বেশি আধুনিক রকেট ও কামান পাবে। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যে এইচআইএমওআরএস রকেট দিয়েছে তা এর মধ্যেই রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং তা যুদ্ধের ভারসাম্য বদলে দিচ্ছে বলেই বলা হচ্ছে।যুদ্ধ যতই দীর্ঘ হবে ততই ইউক্রেনের হাতে এর আরো সরবরাহ আসবে, এবং তারা যুদ্ধে আরো বেশি সুবিধা পাবে।অন্যদিকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়াও তার খরচ হয়ে যাওয়া সরঞ্জাম ও গোলাবারুদের শূন্যস্থান পূরণ করতে সমস্যায় পড়ছে।নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যাচ্ছে না রাশিয়া ও ইউক্রেন- দু’পক্ষই দাবি করছে যে তারাই যুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে।এখনকার পরিস্থিতিতে কোন কিছুই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।বিবিসির জো ইনউড বলছেন, একটা বিষয় লক্ষণীয় যে ডনবাসে যদিও ইউক্রেন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে কিন্তু অন্য দিকে তারা সম্প্রতি কিছু সাফল্যও পেয়েছে।যেমন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্নেক আইল্যান্ড থেকে রুশ সৈন্যরা হটে গেছে, সেখানে এখন ইউক্রেনীয় পতাকা উড়ছে।তবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে এ যুদ্ধ খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে না। এবং, লড়াইয়ের পরিণাম ভোগ করার জন্য এখন সম্ভবত তৈরি হতে হবে দোনেৎস্কের বাসিন্দাদেরকে।
সূত্র : বিবিসি