সুনামগঞ্জ সীমান্ত থেকেই ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি এলাকা শুরু। ফলে সেখানকার পানি সরাসরি বাংলাদেশের হাওরে মেশে। ভৈরব কিংবা মেঘনা নদী হয়ে সাগরে চলে যায়। অতীতের বৃষ্টি বেশি হলেও নদী গতিশীল ছিল। এখন নদীতে পানির প্রবাহ নেই বলে মনে করেন গবেষকরা। অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে বৃষ্টির ধরন বদলেছে। এখন অনেক ভারি বৃষ্টি হয়। চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হলে তা ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতরে তাহিরপুরে চলে আসে। সেখানে এসে পানি তো আর দ্রুত নামতে পারছে না। ফলে তখন সেটা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে বন্যা তৈরি করছে। তিনি আশঙ্কা করছেন, চেরাপুঞ্জিতে আরও দু-তিন দিন বৃষ্টি হলে এই বন্যা মহাবিপদ ডেকে আনবে।
মানবসৃষ্ট কারণেও ধুঁকছে সিলেট: চেরাপুঞ্জির রেকর্ড বৃষ্টি কি বর্তমান পরিস্থিতির একমাত্র কারণ? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদনদী ও হাওরে এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যেগুলো পরিবেশসম্মত নয়। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মেঘালয় বা আসাম থেকে আসা বৃষ্টির পানি নদীপথে হাওর থেকে বেরিয়ে মেঘনা বা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যায়। এবারের বন্যার পেছনে হঠাৎ উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি বের হতে না পারাটা প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এ জন্য তাঁরা নদীর নাব্য কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন।
সিলেটের স্থানীয় বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে গতকাল সমকালের কথা হয়। তাঁরা জানান, সিলেট ও সুনামগঞ্জ দুই শহরেই সুরমা নদী ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে ভাগাড়। সিলেট নগরীর কালীঘাট থেকে টুকের বাজার, কালীঘাট থেকে দক্ষিণ সুরমার কুচাই এলাকা পর্যন্ত সর্বত্রই আবর্জনার স্তূপ। একইভাবে সুনামগঞ্জ শহর এলাকায় সুরমা নদীর তীরও বর্জ্যে ভরা। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সাহেববাড়ি সেলুঘাট, উত্তর আরপিননগর, পশ্চিমবাজার, মধ্যবাজার, চাঁদনীঘাট, সুরমা হকার্স মার্কেট, জগন্নাথবাড়ি, প্রধান মাছবাজার এলাকা, জেলরোড ফেরিঘাট এলাকা, লঞ্চঘাট এলাকা, উকিলপাড়া এলাকা, ষোলঘর এলাকায় নদীতীরে স্থানীয় লোকজন নিয়মিত হোটেল-রেস্তোরাঁর পচা ও উচ্ছিষ্ট খাবারসহ নানা রকমের বর্জ্য ফেলছেন। ফলে নদী হারিয়ে ফেলছে তার নাব্য।
দীর্ঘদিন ধরেই সিলেটের পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করছেন আবদুল হাই আল হাদি। তিনি জানান, ভবিষ্যতে বন্যা থেকে মুক্তি পেতে সিলেটের সব নদনদী খনন জরুরি। এ ছাড়া নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছড়াগুলো (প্রাকৃতিক) খনন করে পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ নিশ্চিত করা দরকার। তিনি আরও বলেন, অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজের কারণে নদীগুলো ক্রমে সংকোচন ও ভরাট হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে নদীশাসনের নামে নদীবিধ্বংসী কর্মকা। যত্রতত্র স্লুইসগেট ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণেও নদীর প্রবাহপথ আরও বেশি সংকুচিত হয়েছে। এতে এবার অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে পানি জমে বন্যার সৃষ্টি করেছে।
নদীগবেষক মুমিনুল হক সরকার বলেন, প্রতিবছর উজান থেকে পানির সঙ্গে পলি আর পাথর নেমে আসে। সেটা এসে বাংলাদেশের অংশে নদীর তলদেশ ভরে ফেলে। নদীর পানি বহনের ক্ষমতা কমে যায়। তখন এই নদীতে বেশি পানি এলে সেটা উপচে আশপাশের এলাকা ভাসিয়ে ফেলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার হাওর এলাকার বেশিরভাগ জনপদে শহর রক্ষা বাঁধ নেই। ফলে কোনো কারণে হাওর বা নদীতে পানি বাড়তে শুরু করলে তা খুব দ্রুত শহরে বা আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম বলেন, প্রথম দফা বন্যার পর দ্বিতীয় দফা বন্যার আশঙ্কা নানাভাবে প্রকাশ করা হলেও সে বন্যা মোকাবিলায় সরকারি কোনো উদ্যোগের কথা জানা যায়নি। অথচ মানুষকে সতর্ক করা উচিত ছিল। দায়িত্বশীল মহল থেকে মানুষকে সতর্ক করা হলে এখন সিলেটের মানুষকে এমন দুরবস্থার মধ্যে পড়তে হতো না।