আশফাকুর রহমান রাসেল,চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি: জনবল কাঠামো ও নিয়োগবিধি বাস্তবায়নসহ পাঁচ দফা দাবিতে অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালনের করছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী কল্যাণ পরিষদ। এই কর্মবিরতি চলতে আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। তারই ধারাবাহিকতায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পাঁচটি উপজেলা পিআইও অফিসেও অর্ধদিবস কর্মবিরতি চলছে।
জানা গেছে, এ জেলায় ২০২১ সালের ১২ জুন থেকে ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা না থাকায় বর্তমানে দায়িত্ব পালন করেছেন সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট (নেজারত, সংস্থাপন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা) মো: তৌফিক আজিজ।
সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার মো. মওদুদ আলম খান এবং শিবগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার মো. আরিফুল হক জানান, পিআইও ও আরআরও অফিসগুলো স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর হাতে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় সে অবস্থায় রয়ে গেছে। পরবর্তীতে অনেক নতুন অধিদপ্তর সৃষ্টি হয়ে এবং সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের কোন জনবলের কোন উন্নতি হয়নি। আমাদের দাবিগুলোর নায্য ও সময় উপযোগী।
বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্পসহ দেশের যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও ক্ষয়ক্ষতি লাঘবে, মানবিক সহায়তা ত্রাণ বিতরণে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাংলাদেশকে সারা বিশ্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় যখন দেশ বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তখনও অবহেলিত।
মাঠপর্যায়ে সিংহভাগ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধ্যমে। অথচ এই অধিদপ্তরের জনবল কাঠামো একেবারেই নড়বড়ে। এতে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গুনগুন মান বজায় রাখা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের অনিয়ম করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার অবাধ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় তৈরি হয়েছে প্রতিবন্ধকতা।
২০১২ সালের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আইন প্রনয়ন হলেও আহ জনবল কাঠামো ও নিয়োগবিধি বাস্তবায়নসহ পাঁচ দফা দাবিতে ৪দিন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালনের করছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী কল্যাণ পরিষদ।
তাদের বক্তব্য হলো, কঠিন দুর্যোগ মোকাবিলায় জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২ এর আলোকে প্রস্তাবিত জনবল কাঠামো ও নিয়োগবিধি বাস্তবায়ন, জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (ডিআরআরও) পদের আপগ্রেডেশন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) পদ আপগ্রেডেশন, সচিবালয়ের ন্যায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের কর্মচারীদের পদনাম পরিবর্তন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের সব শূন্যপদ/পদোন্নতি/চলতি দায়িত্ব নিয়োগের মাধ্যমে পূরণের এ পাঁচটি যৌক্তিক দাবি নিয়ে উক্ত অধিদফতরের সংযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ পরিষদ গত ৮/১০ বছর ধরেই সুশৃঙ্খল আন্দোলন করে আসছে।
এ পরিষদ উক্ত অধিদফতরের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা সভা, স্মারকলিপি প্রদান, সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন ইত্যাদিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। এসব দাবির যৌক্তিকত পর্যালোচনায় কর্তৃপক্ষ মৌখিক ঐক্যমত প্রকাশ করলেও বাস্তবায়নের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ পরীলক্ষিত না হওয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
“দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২” আইন কার্যকর হয়েছে প্রায় এক যুগ আগে। অথচ এর আওতায় কর্মরত জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (ডিআরআরও) এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের (পিআইও) জনবলকাঠামো ও নিয়োগবিধি এখনো অনুমোদন হয়নি। পদ দুটির আপগ্রেডেশন প্রস্তাবও পড়ে আছে মন্ত্রণালয়ে। ফলে ডিআরআরও- পিআইওরা কাক্সিক্ষত আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের স্বার্থে কর্মকর্তা কর্মচারী কল্যাণ পরিষদ আগামী ১২ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী অর্ধদিবস কর্মবিরতির ডাক দেয়। এর মধ্যে যৌক্তিক দাবিগুলো আদায় না হলে পরবর্তী কর্মসূচি প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৭ সেপ্টেম্বরের পরে কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
ইতিমধ্যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, পরিদফতরের অধীন পদগুলো যুগোপযোগী করে আপগ্রেডেশন করা হলেও তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ মন্ত্রণালয়ের অধীন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও অন্যান্য কর্মচারীদের পদ অদ্যবধি আপগ্রেডেশন করা হয়নি।
এ অধিদফতরের বিভিন্ন পদ আপগ্রেডেশন ও নতুন প্রায় চার হাজারের অধিক পদ সৃষ্ট হয়নি। এছাড়াও ৪১৬টি পদ শূন্য থাকায় অধিদফতর এবং মাঠ পর্যায়ের কাজ কর্মে স্থবিরতা নেমে এসেছে। ফলে এ অধিদফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মনে চরম হতাশা বিরাজ করছে যা আগামীর যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য বিরাট অন্তরায়।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সংকটে ভুগছে দেশের প্রায় শতাধিক উপজেলা। আর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়গুলো ভুগছে জনবল সংকটে। আমলাতান্ত্রিক ও আইনি জটিলতার রসানলে দিনদিন সংকুচিত হয়ে পড়েছে পিআইও অফিসগুলো। সেই সুযোগে বাড়ছে কর্মকর্তাদের অনিয়ম। অথচ মাঠপর্যায়ের অধিকাংশ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়ে থাকে এ অফিসের মাধ্যমেই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরে অনুমোদিত ৫০৪টি পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত আছেন ৪শো’র মতো পিআইও। এদের মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের পাঁচটি প্রকল্পে বিভিন্ন পদে কাজ করছেন ৩৩ জন। এর মধ্যে হেরিং বোন বন্ড (এইচবিবি) প্রকল্পে নয়জন, গ্রামীণ রাস্তায় ১৫ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত সেতু/কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পে আটজন, মুজিব কিল্লা নির্মাণ প্রকল্পে সাতজন, বন্যাপ্রবণ ও নদী ভাঙন এলাকায় বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র প্রকল্পে সাতজন এবং উপকূলীয় ও ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকায় বহুমুখী আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে দুজন কর্মরত রয়েছেন। এদের অনেকে প্রকল্পেই রয়েছেন পাঁচ থেকে আট বছর ধরে। অথচ মাঠে পিআইও-এর অভাবে সরকারি উন্নয়ন কর্মকান্ড ব্যাহত হচ্ছে। শিগগিরই আরও কিছু পিআইও পদোন্নতি পেয়ে জেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হলে এ সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন।
২০১২ সালের সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখে ’দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২’ প্রজ্ঞাপন জারি হয়। নভেম্বরে অনুমোদন হলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় ’দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর’ (ডি.ডি.এম)।
দুর্যোগ মোকাবেলা বিষয়ক কার্যক্রমকে সমন্বিত, লক্ষ্যভিত্তিক ও শক্তিশালী করা এবং সকল ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তুলার উদ্দেশ্যেই এ আইনটি প্রনয়ণ করা হয়। কিন্তু বিগত ১০ বছরেও তা যৎসামান্য বাস্তবায়ন হওয়ায় এখনো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের আভ্যন্তরীণ কাঠামো খুবই দুর্বল। দিনদিন কার্যপরিধি বিস্তৃত হলেও অধিদপ্তরের সাংগঠনিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। প্রায় সকল উপজেলা ও জেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনবলের ব্যপক সংকট। এজন্য ভয়াবহ দুর্যোগ মুহুর্তেও সরকারের সহায়তা গুলো জনসাধারণের কাছে পৌছুতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনহিতকর পরিকল্পনাগুলো অনেকাংশেই ব্যহত হচ্ছে।
প্রতিটি উপজেলায় একজন পিআইও সাধারণত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়ণ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, বন্যা আশ্রয়ণ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, দুর্যোগ সহনীয় গৃহ নির্মাণ, গ্রামীণ সড়কে ছোট বড় সাইজের কালভার্ট ও সেতু নির্মাণ, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি (কাবিখা), কাজের বিনিময়ে টাকা কর্মসূচি (কাবিটা), টেস্ট রিলিফ (টি আর), ইজিপিপি ( ৪০ দিনের কর্মসূচি), মানবিক সহায়তা কর্মসূচি, ত্রাণ সহায়তা এবং ভিজিএফসহ সরকারের নানা ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকেন।
এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনের জন্য মাঠপর্যায়ের যে অফিস উপজেলায় অবস্থিত। সেখানে সাধারণত একজন প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার ও একজন অফিস সহকারী থাকেন। উপজেলা প্রশাসনিক ভবনের এক অংশে অবস্থিত প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসারের কার্যালয়ে প্রতি বছর প্রায় ৫০ কোটি টাকার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয় মাত্র দুই বা তিন জন মানুষের মাধ্যমে। প্রতি উপজেলায় একজন উপ-সহকারী প্রকৌশলীর পদ থাকলেও তা অধিকাংশ উপজেলায় শুন্য আছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ে ১০টি পদ থাকলেও অধিকাংশ অফিসে ৪ থেকে ৫ জন লোক কর্মরত আছেন। অথচ ’দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২’ এর ধারা ১১ অনুযায়ী- “অধিদপ্তরের কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের উদ্দেশ্যে সরকার প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ করিতে পারিবে এবং তাহাদের চাকুরির শর্তাবলী বিধি দ্বারা নির্ধারিত হইবে।”
গণমাধ্যমে প্রকাশ, গত ৮ ফেব্রুয়ারি দুপুর সাড়ে ১২টা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের তার দফতরে এ বিষয়ে বলেন, মামলার কারণে পিআইও নিয়োগ দিতে পারছি না। দেশের প্রায় ১০০ উপজেলায় পিআইওর পদ শূন্য। কিছু উপজেলায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন পার্শ্ববর্তী উপজেলার পিআইও। অনেক উপজেলায় অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ার মতো পিআইও পাওয়া যাচ্ছে না।’ যেসব উপজেলায় পিআইও নেই সেখানকার এমপিরা প্রতিনিয়ত চাপ দিচ্ছেন। পিআইও নিয়ে হাহাকার শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, আমলাতান্ত্রিক ও আইনি সকল জটিলতা নিরসন করে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসারের কার্যালয়ের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা রক্ষার্থে ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২’ বাস্তবায়ন করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়োগ দেয়া অত্যন্ত জরুরি।