আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নানামুখী হিসাব-নিকাশ কষতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এর মধ্যেই নতুন ফর্মুলা দিয়েছে বিএনপি। দলটি বলছে, আগামী সংসদ নির্বাচন নিরপক্ষে সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে হবে। নির্বাচনে বিজয়ী হলে তারা ‘গণতন্ত্রে বিশ্বাসী’ সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকার গঠন করবে। দলটির এ প্রস্তাবে দেশের রাজনীতিতে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে।
ভিন্ন অবস্থান থাকলেও বিএনপির নতুন ঘোষণাকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখছে সরকারবিরোধী অন্য দলগুলো। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বলছে, ছোট দলগুলোকে জোটে টানার কৌশল এটি। নেতৃত্বহীন ও জনবিচ্ছিন্ন দলটির এসব কৌশলে কোনো লাভ হবে না।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিরোধী জোটে ত্রিমুখী অবস্থান রয়েছে। একপক্ষ চায় নির্বাচনকালীন দুই বছরের জাতীয় সরকার; আরেক পক্ষের দাবি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং বিএনপির দাবি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার। তবে ত্রিমুখী অবস্থান থাকলেও আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে আশা করছে সবপক্ষই
নতুন ফর্মুলার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল সমকালকে বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন করতে হবে। সবাইকে নিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশকে গড়ে তুলতে নির্বাচনের পর জাতীয় সরকারের কথা বলছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারবিরোধী দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্য হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভিন্নমত থাকবেই। আলোচনায় এসব মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এর মধ্য দিয়েই ঐক্য গঠন করা হবে।’ ভিন্ন মতামতে ঐক্য বাধাগ্রস্ত হবে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা আলোচনায় বসলেই পরিস্কার হবে।’
নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন দলের নানা রূপরেখার মধ্যে গত সোমবার লন্ডনে এক আলোচনা সভায় নতুন ফর্মুলা ঘোষণা করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোর নেতারা পৃথক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, আগের অবস্থান থেকে বিএনপি কিছুটা সরে আসছে। আশা করি, তারা দেশ ও গণতন্ত্রের প্রয়োজনে সিদ্ধান্তে আরও পরিবর্তন আনবে।
২০ দলীয় জোটের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, বিগত বছরগুলোতে দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করা হয়েছে। তাদের অধীনে কখনও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচনকালে জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা- এই চারজন জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করেন। তাদের মাধ্যমেই ঠিক হয় কারা ক্ষমতায় আসবে। নির্বাচন কমিশনের কোনো ভূমিকা থাকে না। এ থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। তিন মাসের সরকার দিয়ে এটা সম্ভব নয়।
অলি আহমদ বলেন, বিএনপি যে রূপরেখা দিয়েছে সেটা চিরন্তন নয়। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার নিরসন হবে। যেটা দেশের জন্য ভালো হবে সেটাকেই সবাই গ্রহণ করবে। এলডিপিও সবার ঐকমত্যকে সম্মান জানাবে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমরা আগে বর্তমান সরকারের পতন চাই। এ জন্য জাতীয় ঐক্য এখন সময়ের দাবি। যেমনটা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ে হয়েছে। সরকার পতনের পর আলোচনা করে ঠিক করব- কোন পদ্ধতিতে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়। এখন যদি এই সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সবাই যার যার মতো করে ফর্মুলা দিতে থাকি তাহলে ঐক্য প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে, বাধাগ্রস্ত হবে।’
নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার পক্ষে মত দিয়ে মান্না বলেন, জাতীয় সরকার গঠনের পক্ষে তিনি নেই। জাতীয় সরকার গঠন করতে হলে তার মধ্যে আওয়ামী লীগকেও রাখতে হবে।
জাতীয় সরকার ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানকে সাধুবাদ জানিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সহসভাপতি তানিয়া রব বলেন, বিএনপি জাতীয় সরকার ব্যবস্থার কথা বলেছে। সেটা আগে হোক বা পরে। পার্থক্যটা জটিল কিছু নয়। আলোচনার টেবিলেই এর সমাধান হবে। আমরা এই অগণতান্ত্রিক সরকারের পদত্যাগ চাই। এ বিষয়ে সবাই একমত।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, শুধু একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্তমান সংকটের সমাধান দিতে পারবে না। এ জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দরকার। আগামী তিনটি সংসদ নির্বাচন একই ধরনের অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে করতে হবে।
নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দল পৃথক মতবাদ দিলেও ২০ দলীয় জোটের শরিক অন্যান্য দলের নেতারা বিএনপির সিদ্ধান্তকে সাধুবাদই জানিয়েছেন। তারা বিএনপির সঙ্গেই থাকবেন বলে ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। এসব দলের মধ্যে রয়েছে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), এনপিপি, জাতীয় দল, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, মুসলিম লীগ ও জাগপা।
সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য প্রচেষ্টার মধ্যেও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পৃথক রূপরেখা তুলে ধরছে। সর্বশেষ বিএনপির জাতীয় সরকারের ঘোষিত খসড়া রূপরেখায় বলা হচ্ছে, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকার নয়, নির্বাচনের পর ফলাফলের ভিত্তিতে সব দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার হবে। এ জন্য সবার আগে নির্বাচনকালে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রয়োজন, যাদের অধীন সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তবে তাদের নিয়েই জাতীয় সরকার গঠন হবে। নির্বাচনে শরিক দল জিতলেও সরকারে থাকবে, হারলেও থাকবে। এর মধ্যে এসব শরিক দলের কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতা হেরেও যান, তবু তাদের জাতীয় সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
তবে নির্বাচনের আগে দুই বছরমেয়াদি জাতীয় সরকারের পক্ষে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডি এবং ২০ দলীয় জোটের শরিক কর্নেল (অব.) এলডিপি এবং ঐক্যফ্রন্ট গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাদের মতে, নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকার গঠনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অন্যান্য সব রাজনৈতিক দলের অংশীদার থাকবে। দুই বা তিন বছর এ সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন কমিশনসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করবে। মাত্র তিন মাসে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের পক্ষে প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত করা সম্ভব নয়।
এ ছাড়া নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না এবং গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে। তারা অন্তর্বর্তী সরকারে সরকারবিরোধী আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলোর অংশীদার ও বিভিন্ন পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে গঠন করার প্রস্তাব করেছেন। তার মতে, এই সরকার রাজনৈতিক ঐকমত্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন, একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি এবং ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ইভিএম ব্যবস্থা বাতিল করে ব্যালট পেপারে ভোটের ব্যবস্থা করবে।
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে দুই মাস আগে বৃহত্তর ঐক্য গড়ার ঘোষণা দেয় বিএনপি। এর জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও শুরু করেন দলটির শীর্ষ নেতারা। নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপিসহ আরও বেশ কিছু দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। জোটের বাইরের দলগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা।
নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার :নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর বিএনপি জাতীয় সরকার গঠন করতে চায় বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল বুধবার রাজধানীর নয়াপল্টনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান। জাতীয় সরকার নিয়ে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা কথাবার্তার মধ্যে দলের অবস্থান স্পষ্ট করলেন মির্জা ফখরুল। নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যৌথসভা শেষে দুপুরের পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন তিনি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা নির্বাচন চাই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। সেই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পর যারা আন্দোলন করেছে, তাদের নিয়ে একটা জাতীয় সরকার গঠন করব। এটা আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন।
তিনি আরও বলেন, এই সরকার যে সমস্যা সৃষ্টি করেছে- যদি সত্যিকার অর্থেই একটা নিরপেক্ষ সরকার গঠিত হয় এবং তার অধীনে যদি একটা অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলেই শুধু দেশের চলমান সমস্যার সমাধান হতে পারে। সেই কারণেই আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান খুব স্পষ্ট করে বলেছেন- আমরা একটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে এখন নির্বাচন চাই এবং সেই নির্বাচনের পর আমরা সবাইকে নিয়ে একটা জাতীয় সরকার গঠন করার মধ্য দিয়ে বিরাজমান সব সমস্যার সমাধান করতে চাই।