লিটন মুন্ডা, চুনারুঘাট প্রতিনিধিঃ বিপুপ্ত প্রায় প্রাচী ঐতিহ্য মাথায় ধারণ করে যথাযথ মর্যাদার সাথে পালন করছে ডন্ড কালি কে আঁকড়ে ধরে রেখে উদযাপন করছে পারকুল চা বাগানের পারকুল দন্ড নাট্য সংস্থা। চা বাগানের প্রতিটি জাতির ( প্রায় ৮৫ টির অধিক) রয়েছে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি-কৃষ্টি,ইতিহাস,পুজা-পার্বণ ইত্যাদি। এ রকম একটি জাতি হচ্ছে “ঊড়িয়া” । তাঁরা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে (চৈত্র অমাবস্যায়) ১৩ দিন যাবত একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক উৎসব পালন করে চা বাগানে “ডন্ড” নামে পরিচিত। মূলত হিন্দুধর্মাবলম্বীদের দেবতা মহাদেবের বা মা কালীর ব্রত পালন করার হয়ে থাকে।
বিশেষ এক ধরনের পোশাক (লালসালু) পরিধান করে, বাদ্যযন্ত্র (ঢাক,করতাল ঘণ্টা,খঞ্জনি,ইত্যাদি), মামণির (কালি মাতা) ছবি কাপড়ে মুড়িয়ে, হাতে জয়পতাকা নিয়ে তারা ১৩ দিনের জন্য ঘর-বাড়ি ছেড়ে এক চা-বাগান থেকে আরেক চা বাগানে যান। যাবার পথে তারা বিশেষ কিছু স্থানে অবসর নেন। যেমনঃ পাহাড়ের বড় কোন বটগাছ যেখানে কোন দেবতার পূজা করা হয়, কোন মন্দির ইত্যাদি)। ১৩ দিনের জন্য ঘর ছাড়ার পূর্বের তিন দিন তারা নিজেকে শুদ্ধ ও পবিত্র করে নেন। এজন্য তারা উপবাস থেকে বিশেষ কিছু নিয়ম-কানুন পালন করেন। আগের দিন সন্ধার সময় তারা নদী বা গাং(ছোট নদী) এর তীরে গিয়ে মা কালীকে তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ দিয়ে আসে। তারপর যাবার দিনে মা-কালীকে তারা পূজা দেয় এবং তাদের যাত্রা সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা চান। মা-কালী তাদেরকে যে দিকে যেতে বলেন তারা সেদিকেই দল-বল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তাঁদের স্ত্রীরা স্বামীর মঙ্গলের (যাত্রাপথে যাতে কোন অসুখ-বিসুখ না হয়,দুর্ঘটনা না ঘটে) জন্য বিশেষ কিছু নিয়ম-কানুন করেন,যেমন ঝাড়ুর পরিবর্তে নিজের পরিধেয় শাড়ী দিয়ে ঘর পরিস্কার করা (ঝাড় দেয়া), নিরামিষভোজী (মরিচ-পেঁয়াজ-লবণ তেল ছাড়া এক সিদ্ধ খাওয়া) হওয়া ইত্যাদি।
নিজ এলাকা ছাড়ার পূর্বে এই ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক এই দলটি বিশেষ কিছু প্রস্তুতি নেন। তারপর মা কালীর নামে ১৩ দিনের বিশেষ ব্রত পালনের জন্য ঘর ছাড়েন। তারা পায়ে হেঁটে এক চা বাগান থেকে আরেক চা-বাগানে পায়ে হেঁটে যায়( এমনকি ৫০ – ৬০ কিলোমিটার পথ)। যাবার পথে তাঁরা নিজ ভাষায় বিশেষ এক ধরণের ধর্মীয় স্লোগান দেন। “কড়া গঞ্জিবাড়ো যুগনিদ্রা …সাবধান …মনিমা … শিবো সংকরো হে … ভক্তরো মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করো হে…”। এটি বলে তাঁরা অত্র এলাকার অসুখ-বিসুখ,ভূত-প্রেতকে সাবধান করে দেন ও ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য ঈশ্বরকে অনুরোধ করেন। এই স্লোগান দিয়ে তাঁরা পায়ে হেঁটে একটির পর একটি চা বাগান অতিক্রম করেন। যে চা বাগান নিজ উদ্যোগে এই দলটিকে তাদের চা বাগানে অবস্থান করার অনুরোধ জানায় তাঁরা সে চা বাগানে অবস্থান নেন। তবে কারো বাড়িতে নয়, কোন মন্দির বা বট তলায় তাঁরা অবস্থান নেন এবং সেখানেই রাত্রী যাপন করেন(একদিন বা দুইদিন)। সন্ধ্যা বেলায় আনুষ্ঠানিক পূজা শেষে রাতে তাঁরা বিশেষ এক ধরণের ধর্মীয়-সামাজিক নাটক পরিবেশন করেন, যা দেখার জন্য চা-বাগানের মানুষ দীর্ঘ এক বছর ধরে অপেক্ষা করেন। অত্র চা-বাগানের সকল ধরণের অসুখ-বিসুখ ও বিভিন্ন ধরণের সমস্যা সমাধানের জন্য নাটকের এক পর্যায়ে (রাত ১২ টায়) তাঁরা মা কালীকে আহব্বান করেন।
ডন্ডে যেসব অনুষ্ঠানে তুলে ধরা হয়ে থাকে – ডুলিয়া খেলা, দুনা খেলা, হাড়ি হারিয়ানি,পরবা নিত্য, শিব পরবর্তী, নন্দি বন্দি, দূর্গা কাটাম অথবা কালী কাটাম, চরয়া, শিব- পার্বতী নৃত্য, ধর্মীয় নাটক।চা-বাগানের বিলুপ্ত প্রায় এই সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য সবাই এগিয়ে আসতে হবে।
ডন্ড হচ্ছে ঊরিষা ঐতিহ্য ,ডন্ডের প্রধান কয়টি জাতি বন্টন করা আছে তাদের মধ্যে রয়েছে:- প্রথমেই সবর জাতি , নায়েক জাতি, কন্দ জাতি, চাষা জাতি, তারপর ঊরিষা জাতি।তারাই প্রধানত ডন্ড ব্রত টা করে থাকে তাদের ছাড়া ডন্ড ব্রত অসম্পূর্ণ। জনসাধারণের কাছে এটা বর্তমানে একটা নাট্য মনে হয় কিন্তু এ নাট্যটা শিব পার্বতীর নাট্য শুধুমাত্র ঐ উপরের জাতি সমাজের লোকেরা এই ব্রত টা ধরে রেখেছে। কিন্তু অনেকে এই ব্রত কে অবিশ্বাস করে।