চাঁদপুর: এখন ইলিশের মৌসুম। বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগরম চাঁদপুরের বড়স্টেশন বাজার। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইলিশের পাইকারি এই বাজারে ক্রেতার ভিড় বাড়তে থাকে। এখানকার ইলিশের বড় জোগান দেশের দক্ষিনাঞ্চল অর্থাৎ সাগর।
তার সঙ্গে মিলছে চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনার ইলিশ। পুরো উপকূলীয় অঞ্চলেই এখন ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ছে সাগরে। আগষ্ট মাসে শুরু হওয়া ইলিশের এই মৌসুম শেষ হবে ডিসেম্বরে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) হিসাবে, একক প্রাকৃতিক পণ্য হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অবদান ইলিশের। জাতীয় অর্থনীতিতে বা জিডিপিতে মাছটির অবদান ১ শতাংশের মতো।
২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৪৬ লাখ ২১ হাজার টন। এর ১২.২৩ শতাংশ ছিল ইলিশ। বিশ্বের উৎপন্ন ইলিশের প্রায় ৭৫ শতাংশই বাংলাদেশে হচ্ছে। মিয়ানমারে ১৫ শতাংশ, ভারতে ৫ এবং অন্যান্য দেশে ৫ শতাংশ ইলিশ মাছ উৎপন্ন হচ্ছে।
সাগরে ইলিশ ধরা পড়ছে বেশি : গত কয়েক দিনের তুলনায় মোকামে ইলিশের দাম কিছুটা কমেছে। চাঁদপুরের সম্রাট বেপারী নামের একজন মাছ ব্যবসায়ী জানান, চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনায় ধরা দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের ইলিশ এক হাজার ৬০০ টাকা থেকে এক হাজার ৬শ’ ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নোয়াখালীর দক্ষিণ হাতিয়া থেকে ইলিশের চালান নিয়ে আসা আলমগীর হোসেন জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় জেলেরা গভীর সাগরে যেতে পারছেন। তাঁদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ছে। ভোলার চরফ্যাশনের মাছ বেপারী রহমত আলী জানান, এবার মাঝারি ও ছোট আকারের ইলিশ বেশি ধরা পড়ছে।
সাগরে সম্প্রতি সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপের পর থেকে বেশ বড় ইলিশও পাওয়া যাচ্ছে। জেলেরা খুব খুশি। ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের তুলাতুলি মাছ ঘাটে জেলে মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, গত ১৫ বছরেও এত বড় ইলিশ দেখা যায়নি মেঘনা নদীতে। এ বছর নদীতে মাছ কম থাকলেও মাঝেমধ্যে জালে আড়াই থেকে তিন কেজি ওজনের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।
ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্যাহ জানান, সাগরে প্রচুর বড় বড় ইলিশ ধরা পড়ছে। এ মাছের কিছু কিছু মাঝেমধ্যে মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীতেও দেখা যায়। তবে সংখ্যায় কম। মেঘনা-তেঁতুলিয়ায় ইলিশ ধরা না পড়ার কারণ অনাবৃষ্টি ও নদীর গভীরতা কমে যাওয়া বলে মনে করছেন তিনি। তাঁর মতে, সাগর মোহনায় ডুবোচরের কারণে মাছ নদীতে আসতে পারছে না। নদী থেকে অবৈধ জাল অপসারণে মৎস্য বিভাগ অভিযান চালাচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক অবৈধ জাল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে।
মোকামে দাম কমেছে: চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল বারী জমাদার মানিক জানান, বাজারে ইলিশের চাহিদা রয়েছে, সরবরাহও ভালো। গত মঙ্গলবার চাঁদপুরের বড়স্টেশনের পাইকারি বাজারে আকারভেদে ইলিশের মণ ছিল ২৪ থেকে ৬৪ হাজার টাকা, যা গত সপ্তাহের চেয়ে চার থেকে ছয় হাজার টাকা কম।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মহিপুর মৎস্য আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি দিদার উদ্দিন আহমেদ জানান, এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশের প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭০ হাজার টাকা। ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৫ হাজার টাকায়। এর ছোট ইলিশ ২২ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ইলিশ উৎপাদনে বাধা ও বিচরণক্ষেত্র বদল: দুই দশক আগেও দেশের মাত্র ২৪টি উপজেলার নদীতে ইলিশের বিচরণ ছিল। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়। কিন্তু সাগর মোহনায় নদীতে জেগে ওঠা চর ইলিশের পথ আটকে দিচ্ছে। আবার ইলিশের ছয়টি অভয়াশ্রমের আশপাশে গড়ে উঠছে নানা অবকাঠামো। এতে ইলিশের বিচরণক্ষেত্রও বদল হচ্ছে।
সামুদ্রিক মাছ ইলিশ ডিম পাড়ার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিত বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতের নদীগুলোকে। একসময় ইলিশের প্রজননের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থান ছিল দেশের নদীগুলোর উজান অংশ। সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রজননক্ষেত্র পরিবর্তন হয়ে নেমে এসেছে ভাটির দিকে; বিশেষ করে হাতিয়া ও সন্দ্বীপ অঞ্চলে। উজানের অনিরাপত্তাই মাছটির প্রজননক্ষেত্র পরিবর্তনের প্রধান কারণ।
এ ছাড়া সাগরের পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ইলিশ নদীতে আসতে দেরি হচ্ছে। বৃষ্টিও কম হয়েছে এবার। বৃষ্টি ও তাপমাত্রার এ ধরনের আচরণে ইলিশের পেটে ডিম আসার সময় পিছিয়ে গেছে। ইলিশের জীবনচক্রে পরিবর্তন এসেছে।
ইলিশের আকারেও পরিবর্তন আসছে। এ অবস্থায় মাছটির প্রজননস্থল ও অভয়াশ্রমগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে উৎপাদন কমতে পারে।
উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব: বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) ‘জাটকা ও ইলিশের প্রাচুর্যতা ও বিচরণক্ষেত্র রক্ষা এবং জেলেদের বিকল্প আয়ের উপায় নির্ধারণ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রজনন মৌসুমে প্রায় দেড় কোটির বেশি মা মাছ ধরা হয়। আর প্রতিবছর দেশের নদীগুলো থেকে ৩৫ কোটির বেশি জাটকা মাছ ধরা হয়। এসব জাটকা ইলিশের স্বাভাবিক বৃদ্ধির সুযোগ দিলে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। আশার বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে জাটকা বিষয়ে বেশ সচেতনতা অর্জিত হয়েছে।-খবর কালের কন্ঠ অনলাইন।
সম্পাদক:সাহিদুর রহমান
অফিস:২৭/১১/২, তোপখানা রোড, পল্টন মোড়,ঢাকা -১০০০।
ফোন: ০১৯১১- ৭৩৫৫৩৩ ই- মেইল : [email protected], [email protected]