মোঃ শামীম খান, বরিশাল সিটি প্রতিনিধি : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আহবানে ত্রিশ লক্ষ আত্মবলিদানকারী সাহসী বীরদের একজন হলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার আগরপুর ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামে মহিউদ্দিন এর জন্ম। পিতা মোতালেব হাওলাদার এবং মাতা সাফিয়া বেগম। তিন ভাই, দুই বোনের সংসারে আদরণীয় ছিলেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। ১৯৪৯ সালের ৮ মার্চ (মতান্তরে ৭ মার্চ) মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর জন্মগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার মাসে আজ ১৩ মার্চ শনিবার সকাল ১১ টায় নগরীর কাশীপুর, বন বিভাগের অফিসের বিপরীতে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর এর শহীদ স্মরণিকা ভবনে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর এর পরিবারের বড় বোন রাহানুর বেগম (৭২) কে দেখতে যান বিভাগীয় কমিশনার বরিশাল মোঃ সাইফুল হাসান বাদল ও জেলা প্রশাসক বরিশাল জসীম উদ্দীন হায়দার। এসময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বরিশাল প্রশান্ত কুমার দাস, বিভাগীয় কমিশনার বরিশাল এর একান্ত সচিব পিয়াস চন্দ্র দাস, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট (এনডিসি) বরিশাল মোঃ নাজমূল হুদা, বড় বোনের ছেলে শহিদুল ইসলাম তনু, বড় বোনের নাতি রুদ্র উপস্থিত ছিলেন। তিনি প্রায় ২ বছর ধরে প্যারালাইস্ট হয়ে বিছানায় পারে আছেন। এসময় বিভাগীয় কমিশনার বরিশাল এর পক্ষ থেকে বড় বোন অসুস্থ রাহানুর বেগমকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান বিভাগীয় কমিশনার বরিশাল মোঃ সাইফুল হাসান বাদল। পাশাপাশি তাকে দেখতে ফলমূল নিয়ে যান তার বাসায়। এসময় তার চিকিৎসা সেবা ও বসতবাড়ির সমস্যা সমাধানে আশ্বাস প্রদান করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে প্রয়োজনীয় নিদের্শনা প্রদান করেন। বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর এর পিতা একজন বাউলশিল্পী ছিলেন। তিনি মুলাদী মাহমুদজান পাইলট হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। তিনি সেই স্কুল থেকেই সাফল্যের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসসি) পাশ করেন। তিনি ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সেখান থেকেই আইএসসি পাশ করেন। এইচএসসি পাশ করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা যাওয়া কালে। একদিন তিনি দেখলেন সেনাবাহিনিতে লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি। আবেদন করলেন এবং তাঁর স্বপ্ন সফল হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনিতে যোগ দেন। ১৫তম শর্টসার্ভিস কোরের প্রশিক্ষণার্থী ক্যাডেট অফিসার হিসেবে মনোনীত হলেন তিনি। ১৯৬৭ সালের ৩ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ না করেই তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি ‘কাকুল’এর উদ্দেশে রওয়ানা হন। সেনাবাহিনিতে তাঁর নম্বর ছিল পিএসএস-১০৪৩৯। দীর্ঘ আট মাসের প্রশিক্ষণ শেষে ২ জুন ১৯৬৮ তিনি সোনাবাহিনির ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট পদে কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৮ সালের ৩ ডিসেম্বরে তাঁকে লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। আরও উন্নত প্রশিক্ষণের পর ১৯৭০ এর ৩০ আগস্ট তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। তিনি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আঙ্গুল উঁচিয়ে এক ভাষণ দিয়ে দিলেন। জানিয়ে দিলেন-আর নয়, এবারে আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে তোমাদের মোকাবেলা করব। এর মধ্যে ২৫ মার্চ কালো রাত্রে পিশাচের দল নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলে পড়ে। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ গভীর রাতেই সারা পৃথিবীর মানুষের উদ্দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বক্তব্য দেন। ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার খবর শুনে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ভীষণভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠেন। তখন তিনি পাকিস্তানের কারাকোরাম এলাকায় ১৭৩ ইঞ্জিনিয়ার্স ব্যাটেলিয়নে কর্মরত ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্য ৪ জন বাঙ্গালী বন্ধুকে সাথে নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেন। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে পাঠানো হয় সবচেয়ে বেশি যুদ্ধবিক্ষুব্ধ ৭নং সেক্টরে, মেহেদীপুর ক্যাম্পে। মহিউদ্দিনকে একটি সাবসেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি তাঁর সাবসেক্টরকে নিজের মতো করে তৈরি করে নেন। মহোদিপুরের সবচেয়ে কাছের শত্রু ঘাঁটি কানসাট। তিনি কানসাট অপারেশন সফলভাবে পারিচালনা করেন। তিনি এভাবে একের পর এক যুদ্ধে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বীরত্বের প্রমাণ দিয়ে শত্রুপক্ষকে নাস্তানাবুদ করতে থাকেন এবং শত্রুঘাঁটি দখলমুক্ত করতে থাকেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বারঘরিয়ায় অবস্থান নেন।পরিকল্পনা হলো, বীরদর্পে আক্রমণ চালিয়ে সেই ঘাঁটি দখল করবে। কিন্তু অজানা কারণে সেইদিন ভারতীয় বাহিনি শত্রুসেনাদের ওপর গোলা বর্ষণ করেনি। মহিউদ্দিন ১২ এবং ১৩ ডিসেম্বর অনেক চেষ্টা করেও ভারতীয় বাহিনির সাথে ওয়ারলেস যোগাযোগ করতে পারেননি। তিনি এতদূরে এসে আক্রমণ না করে ফিরে যাবার পক্ষপাতী ছিলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন ভারতীয় বাহিনির আর্টিলারি কাভার ছাড়াই আক্রমণ করে ফেলবেন। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, ২০ জনের মতো সহযোদ্ধা নিয়ে সকাল ৮ টার দিকে রেহাইচর এলাকা দিয়ে ৩-৪টি নৌকায় করে মহানন্দা নদী পার হলেন মহিউদ্দিন ও তাঁর দল। এরপর শত্রুদের সাথে হাতাহাতি ও সম্মুখযুদ্ধ শুরু হলো। ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হলো সেই যুদ্ধ। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন উত্তরদিক থেকে শত্রু হনন করতে করতে দক্ষিণ দিকে যেতে লাগলেন।
কিন্তু কাজটা তত সহজ ছিল না। শত্রুরা ছিল সুরক্ষিত বাংকারের ভিতরে। সেখান থেকে তারা মুক্তিসেনাদের ওপর কামানের গোলা নিক্ষেপ করছিল। মহিউদ্দিন বাংকার ধ্বংসের কথা ভাবছেন। এর মধ্যে দেখেন এক কিশোর যোদ্ধা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংকারের ওপর দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। এতে করে মহিউদ্দিন তার বাহিনি নিয়ে শত্রু বাহিনির দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন।
শত্রুসেনারা অনেকগুলো বাংকার তৈরি করে রেখেছিল। দুটো ধ্বংস হলেও অন্যগুলো থেকে তারা বৃষ্টির মতো গোলা বর্ষণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের হতাহত করছিল। কয়েকজন সহযোদ্ধা তাঁর চোখের সামনেই মৃত্যুবরণ করেন। মহিউদ্দিন একটি গ্রেনেড শত্রুর বাংকারে ছুঁড়ে সেটি ধ্বংস করে দেন এবং সরে পড়তে চেষ্টা করেন। এমন সময় হঠাত্ করে সাইপারের একটি বুলেট তাঁর একেবারে কপালে এসে লাগে।
সম্পাদক:সাহিদুর রহমান
অফিস:২৭/১১/২, তোপখানা রোড, পল্টন মোড়,ঢাকা -১০০০।
ফোন: ০১৯১১- ৭৩৫৫৩৩ ই- মেইল : [email protected], [email protected]