রেজিঃ নং ডিএ ৬০০৯ | বর্ষ ১৪ | ৪ পৃষ্ঠা ৩ টাকা || রবিবার | ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
পলাশ মাহমুদ, বিশেষ প্রতিনিধিঃবেনাপোল ভৌগলিক সীমারেখায় কেবলমাত্র ভাষার টানে মিলিত হলো দুই বাংলার মানুষ । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষে যশোরের বেনাপোল চেকপোস্ট নোম্যান্সল্যান্ডে রবিবার এভাবেই কাটালেন দুই বাংলার বাংলা ভাষাভাষী মানুষ। একই আকাশ একই বাতাস, দুই বাংলার মানুষের ভাষা এক। আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি ভাষা দিবস মিলিয়ে দিলো ‘এপার-ওপার’। ভাষার দাবিতে আন্দোলনে শহীদদের সম্মিলিত শ্রদ্ধা জানালো ভারত-বাংলাদেশ।বেনাপোল সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে শহীদ বেদি ঢাকল ফুলের চাদরে।
বেনাপোল চেকপোস্ট নোম্যান্সল্যান্ডে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্যদিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবারো ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানো হলো। মিষ্টি বিতরণের মধ্যে দিয়ে দুই বাংলার একই আকাশ একই বাতাস।বিশ্ব ব্যাপি করোনা ভাইরাসের কারনে এবার দুই দেশের মধ্যে সিমিত পরিশরে উদযাপন করা হয় এই উৎসব।
দুই দেশের জাতীয় পতাকা, নানা রং এর ফেস্টুন, ব্যানার, প্লেকার্ড, আর ফুল দিয়ে বর্ণিল সাজে সাজানো হয় নোম্যান্সল্যান্ড এলাকা।প্রতি বছরই দুই বাংলার সীমান্তবর্তী এ অংশের বাসিন্দারা এক সঙ্গে মিলিত হয়ে দিবসটি পালন করেন। তখন দুই দেশের সীমান্তের মধ্যবর্তী ওই স্থানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
সকাল ১০টায় ভারতের পক্ষে থাকবেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রী শ্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, বিশেষ অতিথি উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের প্রাক্তন বিধায়ক ও মেন্টর শ্রী গোপাল শেড সহ সভাধিপতি শ্রীমতি মমতা বালা ঠাকুর, বনগা লোকসভার শ্রী সুরজিত বিশ্বাস, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিধায়ক শ্রী মতি জ্যোৎস্না আঢ্য, সাবেক সংসদ বঁনগা পৌর প্রশাসক শ্রী শঙ্কর আঢ্য বাংলাদেশিদের ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে ও মিষ্টি দিয়ে বরণ করে নেয় একে অপরকে। নোমান্সল্যান্ডে অস্থায়ী শহীদ বেদীতে প্রথম ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান উভয় দেশের জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশের পক্ষে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, বিশেষ অতিথি যশোর-১ আসনের সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দীন, বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার আজিজুর রহমান, জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান, ৪৯ ব্যাটালিয়ন বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল সেলিম রেজা, পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ার্দ্দার ও উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল হক মঞ্জু প্রমুখ ।
ভাষা দিবসের মিলন মেলায় বিজিবি বিএসএফকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। এরপর দুই দেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে হাজার হাজার ভাষাপ্রেমী মানুষ দিবসটি উদযাপন করে যৌথভাবে। এসময় ভাষার টানে বাঙালির বাঁধন হারা আবেগের কাছে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় দুই বাংলার মানুষ। এর মধ্যদিয়ে বোঝা গেল রফিক, শফিক, বরকত ও সালামের তরতাজা রক্ত বৃথা যায়নি।
উভয় দেশের মধ্যকার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তি এখনো যে অটুট রয়েছে তাও বোঝা গেল অনুষ্ঠানে উপস্থিত দুই বাংলার অতিথিদের বক্তব্যে। এরপর ভারতীয় মন্ত্রীসহ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আসা হয় বাংলাদেশের চেকপোস্টের মঞ্চে। এই মঞ্চে শহীদদের স্মরণে কোরাআন তেলোয়াত ও গীতা পাঠের মধ্যদিয়ে শুরু করা হয় আলোচনা সভা। ৫২ এর ভাষা সংগ্রামের পথ ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। আর এই স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জনগণ ও সরকার আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সঙ্গে আমাদের আত্মার সম্পর্ক, নাড়ির সম্পর্ক। সে জন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়েছে আমাদের এই ভাষা আন্দোলন।
দেশের বীর সন্তানরা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করেছে তাদের জাতি শুদ্ধাভরে স্মরণ করবে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন ও ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তিনি বলেন, এদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্র বিকশিত হতে শুরু করেছে।
তিনি দুই বাংলার মধ্যে শুধু একুশের অনুষ্ঠান নয়, অন্যান্য দিবসের সময় এ রকম অনুষ্ঠান করার কথা বলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, আপনারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন।
স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। ভাষা আর স্বাধীনতার জন্য এতো ত্যাগের নজির পৃথিবীতে অন্য কারোর নেই। এ জন্য আপনারা গর্বিত জাতি। ভাষার টানে আমরা বাংলাদেশে ছুটে এসেছি একুশ উদযাপন করতে। দুই বাংলার মানুষ একসঙ্গে মাতৃভাষা দিবস পালন করছে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আপনারা ভাল থাকলে আমরাও ভাল থাকবো।
তিনি আরো বলেন, বিধির কারণে আমাদের বাংলা দুই বাংলায় বিভক্ত হয়ে গেছে। এ বেদনা আমরা প্রতিনিয়ত অনুভব করি। একে অপরকে আলিঙ্গন করা ইচ্ছা আছে কিন্তু মাঝখানে সীমারেখার কারণে তা সম্ভব হয় না।দুপুরে ভারতীয় মন্ত্রী ও একুশ উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের অতিথিদের সঙ্গে করে নিয়ে যান পেট্রাপোল সীমান্তে নির্মিত একুশ মঞ্চে। সেখানে আলোচনা সভায় দুই দেশের মাতৃভাষা উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দসহ অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।ভাষা শহীদদের স্মরণে দুই বাংলার মানুষের সম্প্রতি আর ভালোবাসার বাধনকে আরো সুদৃঢ় করার প্রত্যয় নিয়ে শেষ হয় ভাষা প্রেমিদের মিলন মেলা। সমগ্র অনুষ্ঠানে নেয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তা। কড়াকড়ি আরোপ করা হয় দুই সীমান্তে।বেনাপোল পেট্রাপোল চেকপোস্টে যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বিজিবি ও বিএসএফ অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করে দুই সীমান্তে। সীমান্ত টপকে যাতে কেউ অবৈধভাবে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বিজিবি ও বিএসএফ বাঁশের বেষ্টনি দিয়ে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।জানা যায়, ২০০২ সালে ভারতের ২৪ পরগনা বনগাঁ ২১ উপযাপন কমিটি আর বেনাপোলের সরগম সংগীত একাডেমি নামে দুটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ভারত-বাংলা যৌথ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের সূচনা করেন। পরবর্তীতে ২০০৯ সাল থেকে বৃহৎ পরিসরে দিবসটি পালনে আয়োজন করে আসছেন দুই পাড়ের জনপ্রতিনিধিরা।