রেজিঃ নং ডিএ ৬০০৯ | বর্ষ ১৪ | ৪ পৃষ্ঠা ৩ টাকা || শনিবার | ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
ভবদহের দুঃখ রয়েই গেল,কাজে আসেনি সেচ প্রকল্প
জেমস আব্দুর রহিম রানা যশোর প্রতিনিধি দৈনিক শিরোমণিঃ যশোর-খুলনার দুঃখ হিসেবে খ্যাত ভবদহের স্থায়ী জলাবদ্ধতা রয়েই গেল। ভুক্তভোগীদের দাবির প্রেক্ষিতে সেই জলাবদ্ধতা নিরসনে বিএডিসি ও পাউবো যৌথ উদ্যোগে সেচ কার্যক্রম শুরু করেও আশানুরুপ কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে ভবদহ স্লুইচ গেট দিয়ে সেচ পাম্পে পানি নিস্কাশন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা মনে করছেন এই ব্যয়বহুল প্রকল্পটি কোন সুফল বয়ে আনতে পারেনি বরং বিলে পানি না থাকায় গেল বছরের তুলনায় এবার বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ আরো কমে গেছে। এখনও অন্তত ২০ গ্রামের লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে।এদিকে ব্যয় বহুল এ সেচ প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তার ওপর স্লুইচ গেটের তল দিয়ে লিকেজ (পানি টেকা নদীতে ফিরে আসা) হওয়ায় শুধুই পাম্পে পানি নিস্কাশন হচ্ছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বিষয়টি বিএডিসি কর্মকর্তারা একাধিকবার পাউবোর কর্মকর্তাদের অবহিত করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।সম্প্রতি কৃষি সচিব, বিএডিসির চেয়ারম্যান, খুলনা বিভাগীয় প্রধান (সেচ প্রকল্প)সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভবদহ এলাকায় পরিদর্শন করেন এবং লিকেজের বিষয়টি ধরা পড়ে। এ নিয়ে যশোর সার্কিট হাউজে কৃষিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এক সভায় পাউবোকে লিকেজের বিষয়টি দ্রুত সমাধানের নির্দেশ দেওয়া হয়।পাউবো সূত্র জানায়, ভবদহ তৎসংলগ্ন বিলে ফসল ফলাতে ও পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পাউবো (পানি উন্নয়ন বোর্ড) ও বিএডিসি (বাংলাদেশ কষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) যৌথ উদ্যোগে চলতি বছরের শুরুতেই এ কার্যক্রম শুরু হয়।বিএডিসির খুলনা বিভাগীয় প্রধান (সেচ বিভাগ) আব্দুল্লাহ আল রশিদ জানান, এ অঞ্চলের বিলে ফসল ফলাতে ও মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পাউবোকে বিএডিসি ৩০ এইচপি (হর্সপাওয়ার) পাওয়ারের ২০টি পাম্প সরবরাহ করে। যা রক্ষণাবেক্ষণে বিএডিসির ৮ জন লেবারসহ একজন উপ-প্রকৌশলী সেখানে সার্বক্ষণিক দেখভাল করে থাকেন। কিন্তু লিকেজ দৃষ্টিগোচর হওয়ায় তা পাউবোকে অবহিত করা হলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।গত ১১ সেপ্টেম্বর কৃষি সচিব মো. মেজবাহুল ইসলাম, বিএডিসির চেয়ারম্যান ড. অমিতাভ সরকার, সরেজমিন পরিদর্শনে আসলে লিকেজের বিষয়টি তাদেরও দৃষ্টি গোচর হয়। গত ১২ সেপ্টেম্বর যশোর সার্কিট হাউজে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের উপস্থিতিতে এক সভায় পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীকে লিকেজের বিষয়টি দ্রুত সমাধানের নির্দেশ দেওয়া হয়।যপবিস-২-এর ডিজিএম (কারিগরি) আবু হেনা শফিক কামাল জানান, পাউবোর আবেদনের প্রেক্ষিতে সেচ পাম্প কার্যক্রম চালাতে গত ৪ জানুয়ারি ২০টি সংযোগ দেওয়া হয়। পাম্প চালাতে ৭০০ কেভিএ ট্রান্সফরমার বসাতে কন্সট্রাকশন ব্যয় হয় ৭ লাখ ৬০ হাজার এবং ট্রান্সফরমারের জন্য ব্যয় হয় প্রায় ২৫ লাখ টাকা। পুরো ব্যয় সমিতির পক্ষে করা হয়েছে। এ ছাড়া পাউবো প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে প্রায় ১৪ লাখ টাকা। যদিও ভুক্তভোগীরা বলছেন তাদের কাছ থেকেও খরচ বাবদ বিঘা প্রতি এক হাজার টাকা করে নেয়া হয়েছে।ভুক্তভোগী কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিএডিসির ৮ লেবারের জন্য প্রতিদিন ৪ হাজার টাকা ব্যয়সহ সেচ পাম্পে নির্বিগ্নে পানি সরবরাহে পাউবোর আওতায় প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে টেকা নদী খনন করা হচ্ছে। কিন্তু এত কর্মযজ্ঞের পরও এ সেচ কার্যক্রম এ অঞ্চলের মানুষের উপকারে আসেনি। গেল বারের চেয়ে এবার বোরো মৌসুমে ভবদহ সংলগ্ন বিলগুলোতে ধানের আবাদ কমেছে।মণিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবুল হাসান জানান, গত বোরো মৌসুমে উপজেলায় প্রায় ২৯ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়। ভবদহ সংলগ্ন ৫টি বিলের প্রায় ৪০০ হেক্টর জমিতে এবার বোরো ধানের আবাদ কমে গেছে।ভবদহ পানি সংগ্রাম কমিটির নেতা কমরেড আব্দুল হামিদ বলেন, সম্প্রতি ভবদহ সংলগ্ন ৩০ গ্রামের মানুষের সাথে এক সভায় উপস্থিত একজনও বলেনি সেচ পাম্পে পানি নিস্কাশনে উপকৃত হয়েছেন।বাজেকুলটিয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক পরমানন্দ রায় বলেন, বাজেকুলটিয়া, হাটগাছা, ডহর মশিয়াহাটি, সুন্দলী, আন্দা, ডুমুরতলা, বেদভিটাসহ কমপক্ষে ২০ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।পাউবো যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম বলেন, লিকেজ একটু হচ্ছে কিন্তু তা বন্ধে নানা রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।প্রসঙ্গত, যশোর জেলার মণিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর উপজেলার মুক্তেশ্বরী-টেকা-হরি ও আপারভদ্রা-হরিহর-বুড়িভদ্রা নদী দিয়ে বেষ্টিত । আলোচ্য অঞ্চলে বৃষ্টির পানি ও উজানের বাহিত পানি উল্লেখিত নদী সিস্টেম ও এর সাথে সংযুক্ত খালের মাধ্যমে ভাটিতে নিষ্কাশিত হয়। মুক্তেশ্বরী-টেকা-হরি ও আপারভদ্রা-হরিহর-বুড়িভদ্রা নদী সিস্টেম দুটি কেশবপুর উপজেলার কাশিমপুরে মিলিত হয়েছে এবং মিলিত প্রবাহ ভদ্রা-তেলিগাতী-গ্যাংরাইল নাম শিপসা নদীতে পতিত হয়েছে। মুক্তেশ্বী-টেকা-হরি ও আপারভদ্রা-হরিহর-বুড়িভদ্রা এবং এর সাথে সংযুক্ত খাল গুলোর মাধ্যমে অভয়নগর, মণিরামপুর, কেশবপুর ও যশোর সদর(অংশিক) এর প্রায় ২৭টি ছোট বড় বিলের পানি নিষ্কাশিত হয়। সমুদ্রের নোনা পানি প্রতিরোধে এবং কৃষিযোগ্য মিঠাপানি ধরে রাখার জন্য ষাটের দশকে হরি-টেকা নদীর অভয়নগর উপজেলার ভবদহ নামক স্থানে ২১ ভেন্ট স্লুইস নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে আশির দশক পর্যন্ত ভবদহ স্লুইসের সুফল ভালভাবে পাওয়া যায়।সত্তরের দশকের পর হত এই অঞ্চলে নদীগুলোর মূল উৎস্য প্রবাহ পদ্মা হতে বিছিন্ন হওয়ায় সাগর বাহিত পলি উজানের দিকের নদী ও খালের তলদেশে নিক্ষেপিত হতে থাকে। একারণে শুষ্ক মৌসুমে ভদ্রা তেলিগাতি নদীর মাধ্যমে সাগর হতে প্রচুর পলি বাহিত হয়ে হরি-টেকা-মুক্তেশ্বরী নদী ও আপারভদ্রা-হরিহর-বুড়িভদ্রা নদী ও এর সংযুক্ত খাল গুলোর তলদেশে নিক্ষেপিত হয়ে ভরাট হয়ে যায়, আশির দশকের পর হতে পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার খাল ও নদীগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে পলি প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার কারণে কালক্রমে নদী ও খালের তলদেশে উচু হতে থাকে এবং পার্শবর্তী এলাকাগুলোতে স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। আর একেই যশোর-খুলনার দু:খ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
সম্পাদক:সাহিদুর রহমান
অফিস:২৭/১১/২, তোপখানা রোড, পল্টন মোড়,ঢাকা -১০০০।
ফোন: ০১৯১১- ৭৩৫৫৩৩ ই- মেইল : [email protected], [email protected]
Copyright © 2024 দৈনিক শিরোমনি | shiromoni.com. All rights reserved.