রেজিঃ নং ডিএ ৬০০৯ | বর্ষ ১৪ | ৪ পৃষ্ঠা ৩ টাকা || রবিবার | ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
রেদোয়ান হাসান,সাভার,ঢাকা,দৈনিক শিরোমণিঃ
ভোরের আলো ফোটার আগেই হাঁকডাকে জমে ওঠে বাইপাইল মাছের আড়ত। কঠোর লকডাউনের মধ্যেই ভোর ৫টা থেকে সকাল ১০-১১টা পর্যন্ত বাজারটি সরগরম থাকে লোকজনের আনাগোনায়। এই বাজার দেখে যেন বোঝার উপায় নেই চলমান করোনার ভয়াবহতা। কোন প্রকার স্বাস্থ্যবিধি ছাড়াই দূর-দূরান্তের পাইকার ও আড়তের বিক্রেতারা যেন এখানে মিলেমিশে একাকার। হাত ধোয়া বা হ্যান্ড স্যানিটেশনের বালাইতো নেই। বরং বাজারের অধিকাংশরেই মুখে থাকে না মাস্ক। অল্প সংখ্যকের মাস্ক থাকলেও তা ভরে রেখেছেন পকেটে। কেউ থুতনিতে আটকিয়ে, কেউবা আবার হাতে ঝুলিয়ে ঘুরছেন বাজার জুড়ে। যদিও বাজার কতৃপক্ষ স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে নিজেরা ভীষণ সজাগ রয়েছেন বলে দাবি করছেন। আর বিশাল এই বাজারে স্বাস্থ্যবিধি প্রশাসনের নজরদারি ছাড়া কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় বলেও জানান তারা।
কঠোর লকডাউন শুরুর প্রথম দিন থেকেই সরেজমিনে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক ঘেঁষা আশুলিয়া থানা মৎস ব্যবসায়ী মার্কেট ঘুরে স্বাস্থ্যবিধির অমান্যের এমন চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। অথচ সাভারের সর্ববৃহৎ এই মাছ বাজার থেকে কিছু দূরেই আশুলিয়া থানার অবস্থান থাকলেও এখানে কোন পুলিশি নজরদারি এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। যেখানে প্রতিদিন প্রায় ৫-৭ হাজার মানুষের সমাগম হলেও স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি একেবারেই নজরে আসেনি উপজেলা প্রশাসনেরও।
আশুলিয়া থানা মৎস ব্যবসায়ী মার্কেট মাছ বাজার ঘুরে অগণিত স্বাস্থ্যবিধি অমান্যকারীদের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
এসময় হাজী শাহাদাত হোসেনের আড়তে থাকা এক বিক্রেতাকে দেখা যায় জনসমাগমের মধ্যে মাস্ক ছাড়া মাছ বিক্রি করছেন। মাস্ক ছাড়া কেন আছেন এমন প্রশ্নে হতচকিত হয়ে নানা অজুহাত দেখাতে শুরু করেন তিনি। বাজারে হাজার হাজার লোক সমাগম হলেও তখন বলছেন আগের চেয়ে পাইকাররা আসছে কম।
এসময় তিনি বলেন, ‘ভোর ৫টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত এই বাজারে মাছ বিক্রি হয়। আগের থাইকা পাইকার অনেক কম। যারা আশেপাশের পাইকার এরাই শুধু আসতেছে। দূরের পাইকার আসতে পারতাছে না।’
মাস্ক কেন পড়েন নাই এমন প্রশ্নে বলেন, ‘ঢুকতেই ব্যানার লাগানো আছে। সবাই মাস্ক পড়ে ঢুকতে হবে, দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। আমি মাস্ক খুলে রাখছি এ জন্য আমি কথা বললে দূরের থেকে শুনতে পারে না। মাস্ক হাতে ছিল। লোকজন নাই ফাঁকা তাই।’
অনেকেই আবার মাস্ক না পড়ার নানা ভিত্তিহীন অজুহাত দেখিয়ে শেষমেষ করোনার ভয়াবহতার কথা জানিয়ে ভুল স্বীকার করেন।
আড়তের আরেক বিক্রেতা বলেন, ‘মাছটা নামাইছিতো সাজাইতেছি। মাস্ক পকেটে আছেতো। মাছের পানি ছিইট্টা আহে দেইখা ময়লা মাইখা যায়। মাছের পানি ছিটে প্রচুর। এর জন্য খুইলা রাখছি।’
করোনার ভয়াবহতার বিষয়ে বোঝানোর পর দ্রুত মুখে মাস্ক লাগিয়ে বলেন, ‘আমারই ক্ষতি হয়। সমস্যা আমারই এইডা। অজুহাত দেয়াটা ঠিক হয় নাই।’
অনেক মানুষের মাঝে বসে দিব্বি মাস্ক ছাড়া টাকা গুনছিলেন দেলোয়ার হোসেন নামে আরেক আড়তদ্বার। মাস্ক নেই কেন জিজ্ঞেস করতেই হকচকিয়ে যান তিনি। দ্রুত টেবিলের উপর পড়ে থাকা সুতাবিহীন ছেড়া একটি মাস্ক দেখিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
তিনি বলেন, ‘আরে ভাই ট্যাকা গুণতাছি। মাস্কতো এহানে থুইছি বোঝেন না ক্যা আপনে? আরে বাবা আমার আড়ত এহানে আমি মাস্কটা এহানে খুলায় রাখছি বুঝেন না কেন? আমার মাস্ক এই যে দ্যাহেন না ছিড়া গ্যাছে। হপায় রাখছি আর ছিড়া গ্যাছে। আমি ট্যাকা নিতে গেছিলাম।
আশুলিয়া থানা মৎস ব্যবসায়ী মার্কেটের ম্যানেজার মোহাম্মদ আল আমিন প্রথমে প্রতিবেদককে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন।
পরে তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্যবিধিটার ব্যাপারে আমরা খুব সজাগ আছি। সবাইরে সচেতন করতাছি। কিন্তু দেখা যায় কিছু অসচেতন লোক থেকেই যায়, যাদের কারণে সম্ভব হচ্ছে না। তারপরেও যতটুকু সম্ভব আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চেষ্টা করতাছি কেনাবেচা করার।’
বাজারে কোন স্বাস্থ্যবিধিই মানা হচ্ছে না। এমনকি সচেতনতামূলক একটি ব্যানার লাগানো থাকলেও সেটি উল্টানো কেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা দুই-তিনডা ব্যানার লাগাইছি। আর পার্সোনালি ভাবে আমাদের সবাইরে বলা আছে যে, তোমরা মাস্ক ছাড়া কেউ মাস্ক বিক্রি করতে পারবা না। আর যারা বাহির থেকে আসে তাদেরকেতো আমরা ওই ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। দেখা যায়, হুট কইরা একজন লোক মাস্ক ছাড়া ঢুইকা পড়লো। জোর কইরা আমরা তাকে আটকাইয়াতো জরিমানা করতে পারি না। আমরাতো প্রশাসন না।’
সাভার উপজেলা সিনিয়র মৎস কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আসলে মাছ বাজার বিষয়টাই এমন এখানে লোক সমাগম হয়। গত বছর লকডাউনের সময় আমরা বাজার গুলোকে উন্মুক্ত স্থানে নিয়ে গেছিলাম আর কি। এটা শুধুমাত্র মৎস অধিদপ্তরের উপরেই নির্ভর করে না। সেক্ষেত্রে উন্মুক্ত জায়গাটাও থাকতে হবে এবং সেখানে সবার সমন্বয়ে কাজটা করতে হবে। ঢাকার জেলার অন্যান্য জায়গায় যেমন নবাবগঞ্জ, দোহারে ওরা উন্মুক্ত জায়গায় বাজার নিয়া গেছে। তবে আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কথা বলে জেনেছি, এখনো সাভারে এধরণের কোন সিদ্ধান্ত আসেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি ইউএনও মহোদয়কে বলেছি যে, আমাদের এখানে যে আড়ত গুলো আছে সে গুলোকে পুরোপুরি স্থানান্তর করা সম্ভব না। কিন্তু কোন ভাবে যদি গ্যাদারিংটাকে একটু কমানো যায় অর্থাৎ টাইমটাকে একটু সিফট করা যায়। যেমন সকালে এক দফা হইলো আর বিকেলে এক দফা। তাহলে আর বাজারে মানুষের চাপটা হলো না। মানুষ অর্ধেক কমে গেলেইতো স্বাস্থ্যবিধিটা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে কি পদক্ষেপ নিবেন এমন প্রশ্নে বলেন, ‘মূলত গণতান্ত্রিক চিত্রে বাজার ব্যবস্থাপনায় কিন্তু বাজারের শক্তিতেই বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়। এখন সরকারও প্রশাসনিক পদক্ষেপ কিছু অবশ্যই নিবে।’
সাভার উপজেলার আশুলিয়া সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জাহিদ হাসান প্রিন্স বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি অমান্যকারীদের শীঘ্রই আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে এবং হবে। আর আজকেও একটু পর বাজার গুলোতে ঢুকবো।’