রেজিঃ নং ডিএ ৬০০৯ | বর্ষ ১৪ | ৪ পৃষ্ঠা ৩ টাকা || সোমবার | ২৫ নভেম্বর ২০২৪ | ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
যশোরে আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের দখলে ইউপি নির্বাচনের মাঠ!
জেমস আব্দুর রহিম রানা যশোর জেলা প্রতিনিধি দৈনিক শিরোমণিঃ চলমান ইউপি নির্বাচনে যশোরে বিদ্রোহী প্রার্থীদের দাপুটি শক্তির কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে আওয়ামীলীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীরা। এখন প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোন ইউনিয়নে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। ইতিমধ্যে এক নৌকার প্রার্থী নিজেকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে নিয়েছেন।এ পরিস্থিতিতে আওয়ামীলীগের হাইকমান্ড থেকে যশোরের বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এরফলে নৌকার প্রার্থীরা হতাশা প্রকাশ করছেন।তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, যশোরে আওয়ামীলীগের গ্রুপ রাজনীতির বলি হতে যাচ্ছে নৌকা। চলমান তৎপরতা অব্যাহত থাকলে অধিকাংশ ইউনিয়নে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের পরাজয় বরণসহ তাদের কর্মী সমর্থকদের কেউ কেউ হতাহত হতে পারে।যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন আমাদের প্রতিবেদক জেমস আব্দুর রহিম রানাকে বলেন, ‘আমরা বিদ্রোহী প্রার্থীদের সাথে আলোচনা করছি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন সরে দাঁড়িয়েছেন। অন্যদের সাথেও আলোচনা হচ্ছে।’এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখনো বহিস্কারের সিদ্ধান্ত হয়নি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিশ্চয় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।আগামী ১১ নভেম্বর যশোরের ঝিকরগাছা ও চৌগাছা উপজেলার ২২টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন। আর ২৮ নভেম্বর ভোট হবে বাঘারপাড়া, শার্শা ও মণিরামপুর উপজেলার ইউনিয়নগুলোতে। এই নির্বাচনে ইতিমধ্যে আওয়ামীলীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড থেকে দলীয় প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই অধিকাংশ ইউনিয়নে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। নৌকা ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেই এই হামলা, পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটছে।চৌগাছায় আগামী ১১ নভেম্বর উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এই ১১ ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীর পাশাপাশি ১৩ জন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মাঠে আছেন। উপজেলার পাশাপোল, ধুলিয়ানী, সিংহঝুলী, জগদীশপুর, স্বরুপদাহ, নারায়নপুর ও সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের এই ১৩ বিদ্রোহী প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য দুই দিন সময় বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু গত ২৮ অক্টোবরের উপজেলা আওয়ামী লীগের বেধে দেয়া সময় পার হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে চাঁপে পড়েছেন নৌকার প্রার্থীরা। এরই মধ্যে জগদীশপুর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সংবাদ সম্মেলন করে নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।জেলার ঝিকরগাছা উপজেলা থেকে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সহিংসতার খবর আসছে। ঝিকরগাছার ১১টি ইউনিয়নেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। সোমবার প্রেসক্লাব যশোরে সংবাদ সম্মেলন করে শিমুলিয়া ইউনিয়নের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মতিয়ার রহমান সরদার দাবি করেন, গত ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জহুরুল হক তার নিজের গ্রামে নৌকা ভাঙচুর করে পুড়িয়েছেন। এসময় নৌকা প্রতীকের পোস্টার ছিড়ে তারা আগুন ধরিয়ে দেন।তবে ওইদিনই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জহুরুল হক ও তার এক কর্মীকে মারপিট করেন নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা। তিনি যশোর সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।এছাড়া পানিসারা ইউনিয়নে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নির্বাচনী পথসভা করতে বেজিয়াতলার মালোপাড়ায় গেলে বিদ্রোহী প্রার্থী জাকির হোসেন পিপুলের সমর্থকরা তার পথসভার চারপাশ ঘিরে কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা চালানো হয়। নৌকার প্রার্থীর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। মোহীনিকাঠি বাজারে নৌকার নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়। এ সময় বেশ কয়েকটি নৌকা পুঁড়িয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ করা হয়।এ ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনের সদস্য ঝরনা বেগম দাবি করেন, নৌকার নির্বাচন করার ‘অপরাধে’ তার বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকেই বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা ইউনিয়ন জুড়ে সহিংসতা ছড়াচ্ছে, নৌকার অফিসে হামলা করছে।পানিসারা ইউনিয়নে ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহাজান আলী জানান, পানিসারার প্রায় সব জায়গায় নৌকার অফিস ভাংচুর করা হয়েছে। এছাড়া আওয়ামীলীগ নেতা মীর বাবর জাহান বরুণ তাকে মোবাইল ফোনে নৌকার পক্ষে কাজ করলে জানে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন।গঙ্গানন্দপুর ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী শাহেদুর রহমান শিপলু'র প্রচার মাইক ভাঙচুর করা হয়েছে।এদিকে মণিরামপুর উপজেলার নির্বাচনাধীন ১৬ ইউপির মধ্যে ছয়জন দাপুটে চেয়ারম্যান দলীয় মনোনয়ন পাননি। যাদের সবাই বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। ইতিমধ্যে চালুয়াহাটি ইউপিতে নৌকার প্রার্থী উপজেলা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল ইসলামকে রাজাকারপুত্র আখ্যা দিয়ে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে হয়েছে বিক্ষোভ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি। চালুয়াহাটিতে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল হামিদ সরদার কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে নির্বাচনের মাঠে নেমেছেন।বিদ্রোহী হিসেবে মাঠে আছেন শ্যামকুড় ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মনি। ভোজগাতী ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক মনোনয়ন না পেলেও ব্যাপক জন সমর্থন নিয়ে আছেন মাঠে। এই ইউনিয়নে উপজেলা যুবলীগের যুগ্মআহবায়ক শরিফুল ইসলাম রিপনও বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে সভা-সমাবেশ করছেন। খানপুর ইউপি চেয়ারম্যান গাজী মোহাম্মদ বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে গণসংযোগে নেমেছেন। রোহিতা ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান আবু আনসার বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন।এ ছাড়াও দূর্বাডাঙ্গা ইউনিয়নে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদ পারভেজ, কুলটিয়া ইউনিয়নে কৃষকলীগের সভাপতি আদিত্য কুমার সরকার, হরিদাসকাটিতে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির লিটন, মনোহরপুর ইউনিয়নে সাবেক চেয়ারম্যান বিএম মোস্তফা মহিতুজ্জামান বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।সব মিলিয়ে মণিরামপুরের রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সকল ইউনিয়নেই আওয়ামী লীগের মধ্যে চরম বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। সকল ইউপিতেই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে প্রকাশ্যে মাঠে নেমে পড়েছে।দলীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে আজ (মঙ্গলবার) সকালে বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে নৌকার বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সপক্ষে হাজার হাজার মানুষের মিছিলে মিছিলে সরগরম মণিরামপুর শহর। কোনো কোনো ইউনিয়নের নৌকা বিরোধী গণ জোয়ার দেখে মনে হচ্ছে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হলে নৌকা প্রতীক পাওয়া অনেক প্রার্থীর জামানত টিকবে কিনা সন্দেহ আছে। টাকার বিনিময়ে অযোগ্য প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়নের মাধ্যমে নৌকা প্রতীক দেয়ায় এমন অবস্থা বলে সচেতন মহল মনে করছেন।শার্শা উপজেলার পুটখালী ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের গফফার সরদারের বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন নাসির উদ্দিন, উলাশী ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী রফিকুলের বিপক্ষে বর্তমান চেয়ারম্যান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আয়নাল হক, শার্শা সদর ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান কবির উদ্দিন তোতার বিপরীতে বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন, লক্ষ্মণপুর ইউনিয়নে বর্তমান আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান ও নৌকা প্রতীক পাওয়া আনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনের জন্য মাঠে নেমেছে শামছুর রহমান।এছাড়া বাঘারপাড়া উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের পাঁচটিতে এবার নতুন প্রার্থী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। উপজেলার সব ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। যাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সোমবার জহুরপুর ইউনিয়নে নির্বাচনী সহিংসতায় পাঁচজন গুরুতর আহত হন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাওয়ার সময় যশোরের বাঘারপাড়ার জহুরপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) চেয়ারম্যান প্রার্থী বদর উদ্দিন মোল্যা ও তার ছেলেসহ পাঁচজনকে পিটিয়ে জখম করেছে প্রতিপক্ষ। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাওয়ার সময় হুলিহট্র গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। আহতদের যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।আহত স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি বদর উদ্দিন মোল্যার অভিযোগ, আগামী ২৮ নভেম্বর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাচ্ছিলেন। হুলিহট্র গ্রামে পৌঁছালে তার প্রতিন্দ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আসাদুজ্জামান মিন্টুর লোকজন তাদের উপর হামলা চালায়। হামলায় অংশ নেয় মাসুদ, রশিদ, করিম, জসিম, মমিন ও জাহাঙ্গীর। এ সময় ওই হামলায় তিনি নিজে, তার ছেলে হাসিব ইকবাল লোটাস ও তার কর্মী মাহবুব, চঞ্চল এবং শাহরিয়ার মনুসহ সবাই গুরুতর আহত হন। পরে স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ডাক্তার আহম্মেদ তারেক শামস জানিয়েছেন, মারপিটের শিকার পাঁচ জনের মধ্যে মাহবুবের অবস্থা আশঙ্কাজনক।এ বিষয়ে নৌকার প্রার্থী আসাদুজ্জামান মিন্টু সাংবাদিকদের বলেন, বদর উদ্দিন মোল্যার অভিযোগ সঠিক নয়। ষড়যন্ত্র করে তিনি নৌকার প্রার্থীর বদনাম করে ইস্যু তৈরি করছেন। পাশের শালিখা থেকে বিএনপি-জামায়াত লোকজন এনে কাজ করছেন। নিজেরা মারামারি করে নৌকার বদনাম করছেন বদর উদ্দিন।বাঘারপাড়া থানার ওসি ফিরোজ উদ্দিন জানিয়েছেন , জহুরপুর ইউনিয়নে মারামারির ঘটনায় কয়েকজন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ঘটনাস্থল এবং হাসপাতালে পুলিশের পৃথক দুটি টিম পাঠানো হয়েছে।পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলেও জানান তিনি।
সম্পাদক:সাহিদুর রহমান
অফিস:২৭/১১/২, তোপখানা রোড, পল্টন মোড়,ঢাকা -১০০০।
ফোন: ০১৯১১- ৭৩৫৫৩৩ ই- মেইল : [email protected], [email protected]
Copyright © 2024 দৈনিক শিরোমনি | shiromoni.com. All rights reserved.