নাজিয়া শিলা দুই বোন। একজন আরেকজনকে ছাড়া এক মুহুর্তও থাকতে পারেনা। ছোটবেলা থেকেই দু’জনার এই সখ্যতা। পিঠাপিঠি দুইজন হলে সম্পর্ক অনেক সময় মধুর হয় না। তারা এর ব্যতিক্রম। ঘোরাফেরা খাওয়া-দাওয়া ঘুমানো তাদের সবকিছুই একসঙ্গে। মা পরম তৃপ্তি এবং গর্ব নিয়ে উপভোগ করে কন্যাদের এমন নৈকট্য।
দাদি মর্জিনা দুই নাতিকে বলে, গলায় গলায় ভাব দু’জন দু’জনকে ছাড়া থাকতে পারে না। বিয়ে দিলে কি ভাবে থাকে তা দেখব! নাজিয়া আর শিলা একসঙ্গে বলে ওঠে, ঠিক আছে, থাকো তুমি সেই আশায়। আমাদের দু’বোনের এই বন্ধন ভাঙবে না কোনদিনও। এক মরণ পারে আমাদের আলাদা করতে। তোদের কথা শুনে খুব ভাল লাগলো। প্রাণটা জুড়িয়ে গেল।
বড় বোন নাজিয়ার বিয়ে হয় জামিলের সঙ্গে। একা হয়ে যায় শিলা। বোন নাজিয়াকে ছাড়া তার কিছুই ভালো লাগেনা। নাজিয়ারও বোন শীলাকে ছাড়া ভালো লাগেনা। বোনের জন্য খারাপ লাগায় শিলা বোনের কাছে ছুটে যায়। নাজিয়াকে বলে, আপা তোমার জন্য আমার ভীশন খারাপ লাগে। তুমি তার চেয়ে এক কাজ করো, দুলাভাইকে নিয়ে আমাদের বাড়ি থাকো। তা কি করে হয়! বিয়ে হলে স্বামী বাড়ি হচ্ছে মেয়েদের আসল ঠিকানা। তুমি তো বিয়ে হওয়ার পর এক্কেবারে সংসারী হয়ে গেছো! তোর বিয়ে হলে দেখিস তুইও সংসারী হয়ে যাবি। জামিল হাসতে হাসতে যোগ দেয়। এইযে শালিকা, শুধু বোনের সঙ্গে আলাপ করলেই চলবে। দুলা ভাইয়ের একটু খোঁজখবর তো রাখতে হয়। একজন তো আপনার সেবাযত্নে নিয়েই আছে। আপনার আরেকজনের খোঁজ খবর না নিলেও চলবে। বুঝতে পেরেছি শালীর সঙ্গে কথায় পেরে উঠব না। এরই মাঝে নাজিয়া বাড়ির খবর আসে তার বাবা খুব অসুস্থ। নাজিয়া আর তার স্বামী ও ছোট বোন শিলাকে নিয়ে দূরত্ব চলে যায় বাপের বাড়ি। এসে দেখে বাড়ী ভর্তি লোকজন। মা রাহেলা কান্নাকাটি করছে। চরম দুঃসংবাদ শুনতে পায় তারা। রাহেলা মেয়েকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, মা তোর বাবা আর নেই! পিতৃহারা দুই কন্যা নাজিয়া আর শিলা দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। বাবা পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ায় ছোট বোন শিলার প্রতি নাজিয়ার দায়িত্ব বেড়ে যায়। বিয়ের জন্য ভালো পাত্রর সন্ধান করতে থাকে। শিলার উপযুক্ত পাত্র রায়হান বিবেচিত হলে, রায়হানের সঙ্গে শীলার বিয়ে হয়। শিলা স্বামী রায়হানের সঙ্গে সুখে শান্তিতে সংসার করে।
স্বামী সংসার নিয়ে বেশ সুখেই কাটছিল নাজিয়ার জীবন। হঠাৎ করে এক অশান্তির মেঘ ঘনিয়ে এলো। নাজিয়ার বিয়ের বেশ কয়েক বছর হয়েছে কিন্তু এখনো কোন সন্তান হয়নি।চিরাচরিতভাবে বিষয়টির প্রতি সকলের নজর কাড়ে। জামিলও সন্তানের জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। সন্তান না হওয়ার অপবাদ স্ত্রীর কাঁধে দেওয়ার রেওয়াজ অনুযায়ী শুরু হয় বাদানুবাদ। জামিল নাজিয়ার সঙ্গে সন্তান সন্তান করে ঝগড়াঝাঁটি করে। স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে থেকে সীমা অতিক্রম করতে থাকে। নাজিয়া স্বামীকে বলে, তুমি আমার সঙ্গে ঝগড়া করছ কেন? সন্তান হয় না তাতে আমার কি দোষ! আমারও তো ইচ্ছে করে সন্তানের মা ডাক শুনতে। নাজিয়া কোনভাবেই চূড়ান্ত বিপর্যয় ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। সমস্ত বাধা চোখের জল উপেক্ষা করে স্বামী জামিল দ্বিতীয় বিয়ে করে। সতীনের সংসার শুরু হয় বিপর্যস্ত জীবন। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার পর স্ত্রী নাজিয়াকে আর তার সংসার রাখতে চায়না। নাজিয়া চোখে অন্ধকার দেখে। স্বামীকে অনুনয় বিনয় করে। আমি কোথায় যাব। আমার তো যাওয়ার জায়গা নেই। তিন বেলার জায়গায় আমাকে এক বেলা খেতে দিয়ো তাও আমাকে এই সংসার থেকে তাড়িয়ে না।
আমার সংসার উজ্জ্বল করতে যা দরকার তা দিতে পারে না! তোমাকে সংসারে রেখে আর ঝামেলা বাড়াইতে চাই না। স্বামীর কঠিন উত্তর।
নিজ হাতে তিলে তিলে গড়া এই সংসার থেকে শূন্য হাতে আমাকে বিদায় করতে চাইছ? আমার সংসার ছাড়তে যত না কষ্ট হবে তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে তোমার কথায়। নাজিয়া ভাবে স্বামী যত কথাই বলুক সব নীরবে সহ্য করতে হবে। ধৈর্য ধারণে স্বামী-সংসারের এই আশ্রয় টুকু ধরে রাখতে সে মরিয়া। তাতে কোন কাজ হয়না। অবহেলা আর বঞ্চনার মাত্রা দিন দিন বাড়তেই থাকে। যে ভাত কাপড়ের জন্য ঘোরতর জীবন যুদ্ধ তাও একদিন বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধুমাত্র খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য এই অমর্যাদাকর জীবন অসহ্য হয়ে উঠে তার কাছে। একসময় তার ভিতরে ধিক্কার জন্মায়। আমি আর স্বামীর বোঝা হয়ে দাঁড়াবো না। সে চলে আসে বাপের বাড়ি। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের বেহাল দশা। এসে দেখে মা রাহেলা খুব অভাবের মধ্যে দিন পার করছে। চুলোয় হাড়ি চড়ে না।
অভাবের মধ্যেই মায়ের সঙ্গে কাটতে থাকে তার দিন। কিছু কিছু মানুষ উপর্যপরি বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত হবার জীবন নিয়ে জন্মায়। নাজিয়া বোধহয় জন্মেছিল তেমন জীবন নিয়ে। যেদিকে তাকায় রুদ্ধ হয়ে যায় সে দরজা। হঠাৎ একদিন তার মায়ের মৃত্যু হয়। অভাবের তাড়নায় তাকে চলে আসতে হয় ঢাকায়। ভাগ্য প্রসন্ন বলতে হবে। কষ্টের জীবন শুরুর প্রস্তুতি নিলেও তাকে কষ্টে পড়তে হয়। ঢাকায় এসে যে বাসায় সে কাজ নেয় তাদের মন মানসিকতা ছিল উন্নত। তার কাজকে গৃহপরিচারিকার কাজ মনে করতেন না তারা। নাজিয়ার আচার-আচরণে ছিল ভালো পরিবারের প্রচ্ছন্ন প্রতিফলন। গৃহকর্তা আসিফ আহমেদ ও তার স্ত্রী ফারিয়া আহমেদ তাকে খুব স্নেহে চোখে দেখতন। নাজিয়া তাদের ভালোবাসা পেয়ে মনের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যেতে চেষ্টা করে। নাজিয়া যে টাকা বেতন পায় তা প্রতি মাসে বোন শিলার কাছে টাকা পাঠিয়ে দেয়। নাজিয়া ভাবে পৃথিবীতে বোন তার একমাত্র আপনজন। বোনকে কেন্দ্র করে তার সব আশা-ভরসা বেঁচে থাকা।
এক সময় আসিফ সাহেব ও তাঁর স্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন তারা প্রবাস জীবনে স্থায়ী হবেন। লন্ডনে চলে যাবার সবকিছু চূড়ান্ত হয় তাদের। নাজিয়ার অসহায়ত্ব দেখে তাকেও তাদের সঙ্গে নিয়ে যাবার কথা বলেন। নাজিয়া ভাবে কুলহারা হতভাগ্য জীবনে হয়তো কূলকিনারা হতে পারে। সেও তাদের সঙ্গে যেতে সম্মত হয়। লন্ডনে শুরু হয় ফারিয়ার নতুন জীবন। আসিফ পরিবারের সঙ্গে থাকলেও অবসর সময় তারা তাকে পার্টটাইম কাজ করার ব্যবস্থা করে দেন। ভালোই আয় করে সে। মাসিক আয়ের সব টাকা বোনের কাছে পাঠায়। পৃথিবীতে টাকার ধর্মের সঙ্গে কোন ধর্মের মিল নাই। অর্থ-সম্পদ আপন ধর্মে গতিশীল। শিলার ক্ষেত্রে এই নিয়মটি ধীরে ধীরে সক্রিয় হতে থাকে। বোনের পাঠানো টাকায় জীবন জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠে। ঘরবাড়ি ব্যবসা-বাণিজ্য আশা আকাঙ্ক্ষা সবকিছু পূর্ণ হতে থাকে নাজিয়ার টাকায়। এক সময় নাজিয়া দেশে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। শিলা বলে, দেশে এসে কি করবে। ওইখানে তো ভালো আছো। ওখানে থাকার যখন সুযোগ আছে থাকো। দেশের চেয়ে বিদেশে থাকাই তো ভাল। নিজের দেশের প্রতি হৃদয় টানে। এখানে কিছুই ভালো লাগেনা। আর আপন বলতে তুই একমাত্র বোন। তোর জন্য প্রাণ আমার কাঁদে।
আমি এখানে ভালই আছি। আমার জন্য তোমার হৃদয় কাঁদার দরকারই নেই। ভালো থাকতে হলে কষ্ট তো একটু করতেই হবে। আমি যা বলছি তোমার ভালোর জন্যেই বলছি। আমার ভালো তখনি লাগবে যখন তোর মুখ খানা দেখতে পারবো। এত ভালো লাগা দিয়ে কাজ নেই। যা বলি তাই শোনো। আমার মুখ দেখে তোমার পেট ভরবে না। নাজিয়া বোনের কথায় অবাক হয়। পৃথিবীতে তুই ছাড়া আমার আর কেউ নেই । জন্মের পর থেকে আমরা ছিলাম একই আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ। আর সেই তুই এ ভাবে কথা বলছিস!
সময়ে পরিবর্তন হয়। সময়ের সঙ্গে মনও পরিবর্তন হয়। টাকা না থাকলে মায়া মমতা সবকিছুই তুচ্ছ। বোনের কথায় নাজিয়া মনে আঘাত পায়। বোনের এমন মানসিক পরিবর্তন উদ্বিগ্ন করে তাকে।
সবকিছু উপেক্ষা করে দেশে চলে আসে নাজিয়া। বোনকে দেখে শিলা খুশি হয় না। শিলা ভাবে তার আয়ের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। নাজিয়া বোনকে বুকে তুলে নেয়। কেমন আছিস। শিলা মুখ গোমরা করে রাখে। নাজিয়া রাতে একান্তে বোনের সঙ্গে আলাপ করতে বসে। এক পর্যায়ে সে শিলার কাছে টাকা-পয়সার হিসাব জানতে চায়। শিলা বিরক্ত স্বরে বলে, এসব এখন বাদ দাও। পরে এ নিয়ে আলাপ করা যাবে। সবেমাত্র এসেছো।
লোকজন নাজিয়াকে বলে, আপনি তো বোন আর তার স্বামীর ভালো অবস্থা করে দিয়েছেন। আমার কিছু না। সব আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা।
শিলা বলে, আপা তুমি আমাদের ভালো অবস্থা দেখে জানিনা কি ভাবছো। তুমি হয়তো ভাবতে পারো তোমার টাকায় আমরা এই বাড়িঘর ব্যবসা বাণিজ্য করছি। তা কিন্তু না। না না তা ভাববো কেন? আমার টাকা-পয়সা নিশ্চয় আলাদা করে রেখে দিয়ছিস?
আমার কাছে তোমার কোন টাকা পয়সা নেই। যা পাঠিয়েছো টুকটাক সব খরচ হয়েছে। মানসিক দ্বন্দ্ব একপর্যায়ে প্রকাশ্যে আসে। শিলা বোনকে বলে বসে, তুমি আমার এখান থেকে চলে যাও। নাজিয়া বোনের কথায় অবাক হয়ে যায়। দিশেহারা হয়ে ভাবতে থাকে এখন সে কি করবে। যে বোনের জন্য এত কিছু করলাম। সে এসব কি বলছে! নাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, তোর কাছে আমার যে টাকা পয়সা আছে তা দিয়ে দে।
আমার কাছে তোমার কোন টাকা পয়সা নেই! আশ্চর্য হয়ে দেখে বোন মুখের উপর টাকার কথা অস্বীকার করছে। শিলা তুই এসব কি বলছিস। নাজিয়া বোনেরে কথায় চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়। আমার টাকা পয়সা থেকে তুই আমাকে এভাবে বঞ্চিত করিস না।
নিঃস্ব তো তুমি হয়েই আছো স্বামী সন্তান থেকে। তোমার কোন কিছুই তো নেই!
নাজিয়া বুঝে যায় আলোর প্রদীপ সবার জ্বলে না। একমাত্র বোনকে ঘিরে ছিল তার বাঁচার স্বপ্ন। শেষ সেই কুলও তার হারিয়ে যাচ্ছে। শিলা তার স্বামীকে নিয়ে বেড়াতে যায়। বোন নাজিয়াকে বাড়িতে রেখে। নাজিয়ার চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না। হঠাৎ লোকজনের নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পায়। কয়েকজন লোক ছুটে আসে নাজিয়ার দিকে অস্ত্র তাক করে। ভয়ে নাজিয়ার গা সিউড়ি উঠে। তবু সাহস করে বলে, তোমরা আমাকে মারতে চাও কেন?
আমরা তোমাকে মেরে ফেলার কন্টাক্ট পেয়েছি। নাজিয়া আর তাদের কাছে কোন কিছু শুনতে চায় না। সে বুঝতে পারে তার বোন তাকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে। সে বাঁচার উপায় বের করে। তোমরা আমাকে মেরো না। আমাকে মারার জন্য যে টাকা পেয়েছ আমি তোমাদের তার দ্বিগুণ টাকা দিবো। টাকার কথা শুনে তারা রাজি হয়ে যায়। তারা নাজিয়াকে বলে আপনি এখান থেকে চলে যান। তাদেরকে টাকা দিয়ে নাজিয়া অন্ধকার রাতেই বোনের বাড়ি থেকে বের হয়। পাশেই ছিল নদী। নাজিয়া নিজের জীবন বাঁচাতে অন্ধকার রাতেই নদী দিয়ে পাড়ি দেয়। একটি বাড়িতে এসে সে আশ্রয় নেয়। বাড়িতে দু’জন বৃদ্ধ লোক থাকে। তাদের কাছে নাজিয়া সব কথা খুলে বলে। দয়া হয় তাদের মনে। এরপর নাজিয়া ওই বাড়িতে একটি ঘর তুলে থাকতে শুরু করে। নিজের যা কিছু টাকা ছিল তা দিয়ে সম্বলহীন মানুষের সেবা করে। নাজিয়া নিজেকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত রাখে। মানুষের সেবা করেই সে আনন্দ খুঁজে পায়। ভাবে ভাগ্য কি ঈশ্বরের তৈরি নাকি মানুষের।
৪০ views