রাকিবুল হাসান, গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি : নদীর মতো বড় একটি খাল কীভাবে দিনে দিনে তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে, এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া লবলং খাল। শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে খালটি এখন মৃত প্রায়। জনশ্রæতি আছে লবলং সাগর হিসেবে। একসময় লবলং নদী দিয়ে পালতোলা নৌকা চলত, শোনা যেত মাঝির আকুল করা গান। দখল, দূষণ ও আর্বজনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে গাজীপুর শ্রীপুরের এক সময়ের খর¯্রােতা লবলং নদী। অনাবাদি হয়ে পড়েছে নদীর দুই পাশের ফসলি জমি। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নদীর তীরবর্তী মানুষেরা।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্য মতে শ্রীপুরে ৪৩৮টি শিল্প কারখানা সক্রিয় রয়েছে। তার মধ্যে মাওনা ইউনিয়নেই রয়েছে ৭৩টি। লবলং খালটি ময়মনসিংহের ভালুকার খিরু নদী থেকে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা হয়ে তুরাগ নদীতে এসে যুক্ত হয়েছে। নদীটি স্থানীয় মানুষ ও পরিবেশের জন্য আশীর্বাদ হওয়ার কথা থাকলেও উল্টো অভিশাপে পরিণত হয়েছে। খালের গাজীপুর অংশের শিল্প-কারখানাগুলোর বর্জ্যে সরাসরি খালে পড়ছে। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) গবেষণায় খালে ১৫টি পয়োনিষ্কাশন লাইন এবং ১১টি ডাম্পিং স্টেশন গড়ে উঠেছে। ওই সংস্থাটির গবেষনায় সবচেয়ে দূষিতের তালিকায় লবলং অন্যতম।
এই নদী বা খালকে কেন্দ্র করে এলাকার কৃষিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল। নব্বই দশকে শ্রীপুরে শিল্প কারখানা গড়ে উঠলে খাল দূষণ শুরু হয়। এক সময়ের লবলং এখন মৃত প্রায়। শুধু লবলং নয়, দূষণ-দখলে একই অবস্থা শ্রীপুরের হল— ধাউর, টেংরার খাল, কাটার খাল, সেরার খাল, বৈরাগীরচালার খাল, তরুণের খাল ও সালদহ খাল। গাজীপুরের শ্রীপুরে রাথুরা শালবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত প্রাকৃতিক এক জলাভূমির নাম লবলং সাগর বা লবণদহ নদী।
লবলং খালের মাওনা ইউনিয়নের মাওনা-ফুলবাড়িয় সড়কের দুই পাশে ক্রাউন করাখনা, তেলিহাটি ইউনিয়নের অংশে দখলে অস্তিত্ব হারিয়েছে ধাউরের খাল। শ্রীপুর পৌরসভার বৈরাগীরচালা খালটি শিল্পবর্জ্য ও দখলে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ওই খালের গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি অংশে কয়েক মাস ধরে বর্জ্য ফেলায় পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে পড়ছে। গোসিঙ্গা ও রাজাবাড়ি ইউনিয়নের তরুণের খালটির বিভিন্ন অংশ দখল-দূষণে এখন মৃত।
লবলং খাল দেখে মনে হতো জলে টইটম্বুর এক রাক্ষুসে নদী। সেই রাক্ষসরূপী নদ এখন অস্তিত্ব সংকটে হারিয়ে ফেলেছে তার নদী চরিত্র। এখন কেউ বলে লবলং খাল আবার কেউ বলে লবলং নালা। লবলং ভরাট করে গতিপথ পরিবর্তন করে গড়ে উঠেছে শিল্প কারখানা। সরকারি এসব খাল দখল-দূষণে কোথাও কৃষক, কোথাও প্রভাবশালী এবং শিল্প-কারখানার মালিকেরা জড়িয়ে পড়ছেন। শুধু দখল করেই থেমে নেই, ইচ্ছামত বিভিন্ন জায়গায় খালের গতিপথও পরিবর্তন করছেন। বিভিন্ন শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ্যে মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে গাজীপুরের লবলং খাল বা লবণদহ নদী। কৃষি জমিতে দূষিত বর্জ্য গিয়ে আবাদি জমি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ছে। খালের কিছু দূরে যেসব জমিতে এখনো ফলন হচ্ছে বর্ষা মৌসুমে পানির সাথে ওইসব জমিতে বর্জ্য গিয়ে ফলন কমে যাচ্ছে। উৎপাদিত ফসল মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি হয়ে পড়ছে। অতিমাত্রায় দূষণের কারণে এ খালে কোনো মাছ নেই। এমনকি সাপ বা ব্যংও পাওয়া যায় না।