রেজিঃ নং ডিএ ৬০০৯ | বর্ষ ১৪ | ৪ পৃষ্ঠা ৩ টাকা || বুধবার | ২০ নভেম্বর ২০২৪ | ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
রেদোয়ান হাসান,সাভার,ঢাকা,দৈনিক শিরোমণিঃ
স্বামী খায়রুল ইসলাম পোশাক কারখানায় চাকরি করেছেন ২০ বছর। স্ত্রী সাবিয়া বেগমও প্রায় ৯ বছর কাজ করেছেন বিভিন্ন পোশাক কারখানায়। ২০০৫ ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন এই দম্পতি। স্বামী খায়রুল ইসলামকে কারখানা থেকে ছাটাই করা হয় ২০১০ সালে। আর ২০১৬ সালে চাকরি চলে যায় স্ত্রী সাবিয়ার। স্বামী খায়রুলের চাকরি চলে যাওয়ার পরেই সংসারে শুরু হয় আর্থিক টানাপেড়ন। তারপরও বসে থাকেননি খায়রুল। সামান্য মজুরিতে কখনও রাজমিস্ত্রীর যোগালীর কাজ করেছেন, কখনও প্রখর রোদে ভেঙ্গেছেন ইট। তবে স্ত্রী সাবিয়ার চাকরিকালীন সময়ে সেই অভাব তেমনটা হয়নি । বাসা ভাড়া আর দুই ছেলের ভরনপোষন চালিয়ে কোন ভাবে কেটেছে সংসার। কিন্তু স্ত্রী চাকরি হারানোর পর সংসারে দানা বেঁধে বসে অভাব। তাই সঞ্চয়ও করতে পারেননি এই দম্পতি। বড় ছেলে গার্মেন্টে চাকরি নিয়ে বিয়ে করে হয়ে যায় আলাদা। এখন নয় বছরের ছোট ছেলেকে নিয়ে চরম অসহায়ত্বের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছেন এক সময়কার এই শ্রমিক দম্পতির।
সাভারে আশুলিয়ার পলাশবাড়ী এলাকায় লায়লা পারভিনের বাড়ির একটি ছোট্ট কক্ষে বসবাস খায়রুল-সাদিয়া দম্পতির। খায়রুল এখন ভ্যানে ফেরি করে সবজি বিক্রি করেন। আর স্ত্রী সাদিয়ার বয়স বেড়ে যাওয়ায় কর্মহীন।
খায়রুল আলম বলেন, দেশে কর্ম ছিলো না তাই ঢাকায় আসছি নব্বই সালে। আমার এক ফুপাতো ভাইয়ের কাছে আমি থাকি। আমি যখন নব্বই সালে আসি তখন ড্রাগনে কাজ শিখি স্যোয়েটারে। ৩২৫ টাকা কইরা বেতন পাইতাম। রামপুরা ফোরস্টার নাম কইরা একটা ফ্যাক্টরি ছিলো ওইখানে বছর দুইয়েক চাকরি করি। তারপরে রূপা ফ্যাশন নাম কইরা একটা ফ্যাক্টরি ছিলো ওইখানে কিছুদিন করার পরে ২০০০ সালে আমি আশুলিয়াতে আসি। অ্যারপর আরেকটা ফ্যাক্টরিতে কাজ করিছ। পরে ২০০৩ সালে রপ্তানিতে র্যাংকন স্যোয়েটার ফ্যাক্টরিতে চাকরি নেই। ওভারটাইমসহ সব মিলায় ৫ হাজার টাকা বেতন পাইতাম। তখন সাদিয়ারে দেইখা ভালো লাগলে বিয়া করি। ২০০৪ সালে ইপিজেডের ফ্যাক্টরি থাইকে আমাদের আউট কইরা দেয়। পরে জামগড়াতে আমি আবার রিংসাইন ফ্যাক্টরিতে চাকরি নেই। কিন্তু ২০০৬ সালে গ্যাঞ্জামের ভিতরে ফ্যাক্টরি ক্লোজ কইরা দেয়। অনেক কষ্ট কইরা আবার পল্লীবিদ্য এলাকার মনোরমা স্যোয়েটার ফ্যাক্টরিতে চাকরি নেই। ২০১০ সালে ওই ফ্যাক্টরি থাইকাও আমাদের অনেক শ্রমিকরে বিনা কারণে ছাটাই কইরা দেয়। সীমিত কিছু টাকা-পয়সা দেয়। তারপরের থেকে মনে করেন, যেখানেই চাকরি করি ওই বেতনাদি যাই নিতে হয় মালিকদের কাছ থেকে আমাদের জোরজুলুম কইরা নিতে হয়।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধইরে চাকরি করেছি। তো চাকরি কইরে যে বেতনাদি পাইছি তাতে আমার সংসার অভাব অনটনেই চলেছে। যদি বাচ্চাদের অসুখ হইছে। অসুখ হলে পরে মনে করেন, ওই মাসে আমার আর চাউলের পয়সা হয় নাই। এইভাবেই খুব কষ্ট কইরে দিনযাপন করেছি। আর এখনতো মনে করেন বয়স হইয়ে গেছে ছেলেদের চাকরি নেই। আগেতো স্যোয়েটার ছিলো ছেলেদের চাকরি ছিলো। আর বয়স হইয়ে গেলেতো কথাই নাই। অনেক ঘোরাঘুরি কইরে যখন চাকরি না হইছে তো এখন ওই শাকের ব্যবসা-ট্যাবসা করি। কমবেশি দিন আনি দিন খাই মতনেই চলে। এমনও আছে কোন মাসে ঘর ভাড়া দিতে পারি নাই। এই অবস্থায় তিন-চার মাসের পন্ত ঘর ভাড়াও এখন বাকী আমার।
এসময় তিনি সরকার ব্যবস্থার প্রতি আক্ষেপ করে বলেন, ‘বড় ছেলের বয়স মনে করেন ২০-২২ হইয়ে গেছে। তার বিয়াসাদি দিছি। কিন্তু লেখাপড়া শেখাতে পারিনি। পেটে ভাতি যোগাতে পারিনি তো লেখাপড়া কিভাবে শেখাবো? কত সরকারি গেছে কোন সরকারি শ্রমিকদের দিকে তাকাইনি। কোন দিনি তাকাইনি, এখনও তাকাইনি। আমি কি বলতে পারি আর কি বলব? শুধু কষ্ট ছাড়া আমাদের সুখেরতো কোন পথ দেখিনি। তা কষ্ট ছাড়া কিছু মুখেও আসে না। আগেও কষ্ট করিছি, এখনও কষ্টই করতেছি। এখন যদি আমি হঠাৎ কইরে অসুখ হই বা কোন আমার দুর্ঘটনা ঘটে। তো দুর্ঘটনা ঘইটে যদি মনে করেন আমি রুমে পইড়ে থাকি তাহলে আমার দেখার কোন লোক নাই। তো আল্লাহর কাছে বলি, যাতে আমার দুর্ঘটনা না দিয়া একবারে নিঃশ্বাস ত্যাগ করায়।’
সাবিয়া বেগম বলেন, ‘নয় বছর গার্মেন্টেসে চাকরি করছি। দিন আনছি দিন খাওয়ার মতই। যে বেতন পাইছি ওই বেতনে চলে নাই। অনেক কষ্ট করছি। মনে করেন, একটা জায়গায় তাম্বু টানায় ড্যারা তুইলা থাকছি। ছোট পোলাডা হইয়া অসুস্থ্য হওয়ায় অনেক দেনাদায়িক কইরা চিকিৎসা করছি। এখনও সেই দেনাদায়িকেই আছি। শোধ করবার পারি নাইকা। এখনও অনেক কষ্টের মইধ্যেই আছি। কোন পুঁজি নাই। ট্যাকা পয়সা নাইকা। ব্যাংক ব্যালেন্স নাইকা। কুনরকম কইরা যান বাঁচাইতেছি। কোন পরিবর্তন নাই। বরংচ এখন আরো খারাপের দিকেই যাইতেছি।
গামের্ন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘এই শ্রমিক দম্পতির করুণ পরিণতির কারণ বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে শ্রমিকদের কোন সেফটির ব্যবস্থা নেই। যেমন ভবিষ্যত তহবিল কিংবা একটানা কোথাও কাজ করার সুযোগ নেই। কারণ অধিকাংশ কারখানাতে আমরা দেখি, একজন শ্রমিকের বয়স বেড়ে গেছে কিন্তু একি কারখানাতে তার চাকরির ধারাবাহিকতা গড়ে ৫-৭ বছর। যার কারণে শ্রমিকরা যে ভবিষ্যত তহবিল গঠন করবে সেই সুযোগটা আসলে নেই। আর কারখানাতে তাদের মজুরি এতই কম দেয়া হয় যে প্রতি মাসে সেই টাকা দিয়ে চলাটাই দুস্কর। যার কারণে তাদের ভবিষ্যত তহবিল গঠন করা সম্ভব হয় না।’
‘যে শ্রমিকরা একসময় সমাজে বোঝা দূর করার জন্য সমাজকে ভালো রাখার চিন্তা করে গার্মেন্ট শিল্পে আসছিলো। কিন্তু একটা সময় যাদের বয়স ৩৫ হয়ে যাচ্ছে তারাই আবার চাকরি হারিয়ে সমাজের বোঝা হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে এই দায়টা মূলত রাষ্ট্রকেই নিতে হবে এবং রাষ্ট্রক্ শ্রমিকদের জন্য এমন কোন কল্যাণমূলক ব্যবস্থা করতে হবে। যারা গার্মেন্ট শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি কাজ করবে তাদের জন্য সরকার ভবিষ্যত সেফটির ব্যবস্থা করবে। কারণ এই গার্মেন্ট শ্রমিক রেমিট্যান্স যোদ্ধারাই কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যার কারণে এই শ্রমিকদের ভবিষ্যত যদি ভালো না হয় তাহলে অন্য শ্রমিকরা আর গ্রাম থেকে আসবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে বিজিএমইএর করণীয় হচ্ছে, প্রত্যেকটা কারখানায় প্রত্যেকটা শ্রমিকদের যাতে সার্ভিস ব্যয় চালু হয় সেটার যথা রিতি ব্যাবস্থা নেয়া ।