শেখ তোফাজ্জেল হোসেন দৈনিক শিরোমণিঃ আজ ২৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শ্রমিক নেতা অধ্যাপক আবু সুফিয়ানের ৪৯তম শাহাদত বার্ষিকী। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের কল্যাণ এবং অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় শ্রমিকলীগ গঠন করে সারা বাংলাদেশের যে কয়জন শ্রমিক দরদী মানূষকে ডেকে শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ অধ্যাপক আবু সুফিয়ান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। জাতির পিতা জাতীয় শ্রমিকলীগ গঠন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৬৬-৬৭ সালে শাহ্ মাখদুম হলের ছাত্র সংসদের ভিপি আবু সুফিয়ানকে তৎকালীন শিল্পনগরী, পাট শিল্পের রাজধানী খ্যাত খুলনা অঞ্চলের শ্রমিকদের দেখভালের দায়িত্ব দেন।আজকের এই দিনে খুলনা-যশোর রোডের মহসিন মোড়স্থ ইসলাম ম্যানশনে নিজস্ব অফিসে ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃদ্ধের সাথে মিটিং শেষে বাসায় ফেরার সময় রাত দশটার দিকে রাস্তার ওপর দূর্বিত্তদের ব্রাশ ফায়ারে মাত্র ২৯ বছর বয়সে শহিদ হন। মাত্র ২৯ বছর বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে শ্রমিক সমাজের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মাতৃভূমির স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে বীরপ্রতিক জাতীয় শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের খুলনা জেলা শ্রম সম্পাদক অধ্যাপক আবু সুফিয়ানকে বঙ্গবন্ধু ডেকে বললেন, তোকে জার্মানীর রাষ্টদূতের দায়িত্ব দিতে চাই, তখন তিনি সবিনয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু আমাকে রাষ্টদূত করবেন কিন্তু আমার ৪০ হাজার শ্রমিক তো আর রাষ্টদূত হতে পারবে না। আমার ৪০ হাজার শ্রমিককে রেখে আমি কোথাও যেতে চাই না। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের সাথে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। শ্রমিকদের কতটা ভালবাসলে, শ্রমিকদের প্রতি কতটা হৃদ্যতা থাকলে জাতির পিতার কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাব সবিনয়ে ফিরিয়ে দেয়া যায় তার জলন্ত উদাহারণ শ্রমিক নেতা আবু সুফিয়ান। এর কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধু ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়সহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য অধ্যাপক আবু সুফিয়ান এর নেতৃত্বে বাংলাদেশের শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে কয়েকজন শ্রমিক নেতাকে ৭২ সালে জার্মানীতে এক সম্মেলনে পাঠিয়েছিলেন। দেশে ফেরার পর ১২ দিনের মাথায় তিনি শহীদ হন। তাঁর নামের সাথে মিশে আছে দেশ প্রেমের দীপ্তমান আভা। শ্রমজীবী মানুষের প্রেরণার বাতিঘর, বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষানুরাগী, সমাজ সেবক, ত্যাগী মহান এই মানুষটি জীবনের স্বল্পতম সময়ে খালিশপুরে মহসিন কলেজ প্রতিষ্ঠা করে সেখানে ভাইস-প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। একজন অকুতভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ানের এদেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার অসীম স্বপ্ন ছিল। সবার সব স্বপ্ন সবসময় তো আর পূরণ হয় না।
বিপথগামী কিছু মানুষ সমাজে থাকে যারা সমাজের মানুষের মঙ্গল চায় না।বাংলাদেশের মহান স্বধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বিজয়ের মাসে আমার ব্যক্তি জীবনের চরমতম বেদনাবিধুর দিনে বঙ্গবন্ধুকেও খুব বেশি মনে পড়ছে। আবু সুফিয়ান দূর্বিত্তদের দ্বারা আক্রান্ত এই খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে তৎকালীন খুলনার পুলিশ সুপার বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব উদ্দিন আহমদকে ফোন করে আবু সুফিয়ানের শেষ খবর নেন। বলেন, সুফিয়ানের দেহে যদি এতটুকুও প্রাণ থাকে তাহলে তুমি সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহন করো। বঙ্গবন্ধু এই দুঃসংবাদে খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার শেষ দেখা ১৯৭৫ সালের ১২ আগষ্ট। বঙ্গবন্ধু সেদিন অধ্যাপক আবু সুফিয়ানের স্মৃতি স্মরণ করে সুফিয়ানের সহধর্মীনি হিসেবে আমার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু খুলনায় অধ্যাপক আবু সুফিয়ান এর নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণে আমাদের আকাঙক্ষার বাস্তব রুপ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার মাত্র তিন দিনের মাথায় ইতিহাসের নৃসংশতম হত্যাকান্ডে জাতির পিতা সপরিবারে শাহাদতবরণ করলে আমাদের সে আকাঙক্ষা অংকুরেই শেষ হয়ে যায়।অধ্যাপক আবু সুফিয়ানের সাথে বঙ্গবন্ধুর স্নেহমাখা মধুর একটা সম্পর্ক ছিল।কোঁকড়ানো লম্বা চুলের কারণে বঙ্গবন্ধু তাঁর আদর্শের অকুতভয় এই সৈনিককে আদর করে মোস্তান বলে ডাকতেন। সম্ভবত ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সম্মেলনের দিন সন্ধ্যায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আমাকে এবং অধ্যাপক আবু সুফিয়ানকে দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি তোদের দেখে খুশি কারণ তোরা এক পরিবারে দু’জনই নেতা। অধ্যাপক সুফিয়ান প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা আর আমি তখন খুলনা বয়রা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি। অধ্যাপক সুফিয়ান এর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু যে তিন বছর বেঁচে ছিলেন সবসময় আমাদের পরিবারের খোঁজ রেখেছেন।পিতার দেখানো পথ অনুসরণ করে তাঁর সুযোগ্য দুই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা একান্ত আপনজনের মতো আমাকে এবং আমার পরিবারকে আগলে রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাছে আমি চির ঋণী। অধ্যাপক আবু সুফিয়ান চাঁপাইনবাগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার আড্ডা গ্রামে এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৩ সালের ০১ মার্চ জন্মগ্রহন করেন।অতি ছোট্ট জীবনে আবু সুফিয়ান দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন। তিনি শিক্ষা জীবনে বি এল কলেজ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি পলতা ইয়ুথ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন। যুদ্ধের সময় আসাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে যেসব বাঙালী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন তাদের কাছে পাকিস্তানী সেনা এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল্ সামসদের অত্যাচার, নির্যাতনের কথা শুনে কথিকা তৈরি করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সে কথিকা পাঠ করেন। স্বাধীনতার পর ত্যাগী এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সরকার বীরপ্রতিক উপাধি প্রদান করে। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজনৈতিক জীবনে বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি,বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের খুলনা জেলা শ্রম সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে খালিশপুর, দৌলতপুর, আটরা শিল্প এলাকায় ন্যায্য দাবি আদায়ে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পথচলা বিশাল হৃদয়ের অধিকারী এই মানুষটি শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ে ৪২টি ট্রেড ইউনিয়নের কোনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবার কোনটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক আবু সুফিয়ানকে ৪৯ বছর পরেও আজকের এই দিনে সারা দেশের শ্রমজীবী মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তাঁকে স্মরণ করে এদিন খুলনাসহ সারা দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো, খুলনা মহানগর আওয়মীলীগ আলোচনা,শোকর্যালি, দোয়া মাহফিল এবং কাঙালি ভোজের আয়োজন করে। এবছরও তার ব্যাতিক্রম নয়।দেশ প্রেমিক শ্রমিক দরদী আবু সুফিয়ানের সহধর্মীনি হিসেবে আজ ৪৯টি বছর আমি তাঁর দেখানো পথে তাঁরই স্বপ্নের জলন্ত প্রদ্বীপ বহন করে চলেছি।স্বপ্নচারী কর্মঠ ত্যাগী মানুষটির অবদানকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তাঁর আর্দশ বুকে ধারণ করে রাত নেই দিন নেই শ্রমিকদের পাশে আছি। সারা বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের সুখ-দুঃখকে নিজের করে নিয়েছি। মাত্র ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে ২১ বছর বয়সে আমি মহান এই মানুষটিকে হারিয়ে সেদিন চারিদিকে দু’চোখে অন্ধকার দেখেছিলাম। জীবন তো আর থেমে থাকার নয়, অল্প বয়সে স্বামী হারানোর গভীর শোককে শক্তিতে রুপান্তর করে আমি জাতির পিতার আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করে শ্রমিকদের পাশে এসে দাঁড়াই। এ দেশের লাখো কোটি শ্রমজীবী-মেহনতি অসহায় মানুষের ভালবাসা এবং এ জাতির আস্থার জায়গা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার আর্শীবাদ নিয়ে আজ আমি জনপ্রতিনিধি হয়ে জনসেবার সুযোগ পেয়েছি।আমার আজকের অবস্থান, শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধি আর শ্রমিক নেত্রী মন্নুজান সুফিয়ান হয়ে ওঠার মূল প্রেরণা অধ্যাপক আবু সুফিয়ান এবং তাঁর স্বপ্ন।শহিদ আবু সুফিয়ান শ্রমিকদের অন্তর দিয়ে ভাল বাসতেন। তিনি ছিলেন শ্রমিকদের প্রাণ, শ্রমিকদের অকৃত্তিম বন্ধু। শ্রমিক নেতা অধ্যাপক সুফিয়ান তাঁর কাজের মাধ্যমে লাখো শ্রমিকের হৃদয়ে অনাদিকাল বেঁচে থাকবেন। অনন্তকাল তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর কোটি মানুষের অন্তরে।শেষ কথা বলতে চাই বঙ্গবন্ধু আদর্শের সৈনিক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শ্রমিক নেতা অধ্যাপক সুফিয়ান বেঁচে থাকবেন তাঁর আদর্শের মাঝে, তাঁর স্বপ্নের মাঝে, তাঁর কর্মের মাঝে। গণমানুষের এই নেতার প্রতি আবারও জানাই অজস্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।