গাজীপুর প্রতিনিধি:রাকিব হাসান আকন্দ দৈনিক শিরোমণিঃ গাজীপুরের শ্রীপুরে বরমী ইউনিয়নের ভিটিপাড়া থেকে অজ্ঞাতনামা হিসেবে উদ্ধার করা মরদেহের রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। একমাত্র কন্যা তার মা’কে বুকের ওপর বসে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে। ১১ ফেব্রæয়ারী ওই গ্রামের গভীর জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা নারী মিনারা বেগম (৫৭) শ্রীপুর পৌরসভার ভাংনাহাটী গ্রামের আবু তাহেরের স্ত্রী। শুক্রবার (৪ মার্চ) দুপুরে কালিয়াকৈর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আজমীর হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। মাকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার একমাত্র কন্যা শেফালী (৩৫) গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পূর্ব খন্ড (পুকুরপাড়) এলাকার ফরিদের স্ত্রী। সহকর্মী সোহেল রানা (২৫) শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী থানার খড়িয়াকাজিরচর গ্রামের মেরাজ উদ্দিনের ছেলে। শেফালী ও সোহেল শ্রীপুরের বিজিবেড তৈরী পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। শ্রীপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এস আই) ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আমজাদ শেখ জানান, গলাকাটা অবস্থায় অজ্ঞাতনামা হিসেবে নারীর মরদেহ উদ্ধারের পর থানায় হত্যা মামলা রুজু হয়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে একমাত্র মেয়ে শেফালী ও তার সহকর্মী সোহেল রানাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তারা হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে নারীর কন্যা শেফালী ও তার সহকর্মী সোহেল রানা জানায়, মাকে মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে বুকের ওপর বসে দুই হাত দিয়ে মাথা ও গলা টান দিয়ে ধরলে সোহেল ছুরি দিয়ে জবাই করে। পরে মায়ের মৃত্যু নিশ্চিত হলে সহকর্মীকে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে আসে তারা। এ বিষয়ে তারা গাজীপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শাকিল আহমেদের আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছেন। পুলিশ জানায়, মিনারা বেগম শিশু অবস্থায় তার স্বামী আবু তাহের তাকে ছেড়ে চলে যায়। মিনারা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে শেফালীকে লালন পালন করেন। গাজীপুরের শ্রীপুর পৌর এলাকার কেওয়া পূর্ব খন্ড গ্রামের চাঁন মিয়ার ছেলে ফরিদের সাথে ২০ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। শেফালী তিন সন্তানের মা হন। সে স্থানীয় বিজিডে লিমিটেড নামে তৈরী পোশাক কারখানায় চাকরি ও স্বামী ফরিদ অটোরিকশা চালাতেন। সামান্য বিষয় নিয়ে শেফালী ও ফরিদের সংসারে প্রায়ই কলহ লেগে থাকতো।এ নিয়ে শেফালী তার মা মিনারা বেগমের বাড়ি পার্শ্ববর্তী শ্রীপুর পৌর এলাকার ভাংনাহাটি গ্রামে থাকতেন। মিনারা বেগমের পৈর্তৃকসুত্রে ৯শতাংশ জমি ছিল। তা আট বছর বয়সে শেফালীকে উইল করে দেন মা মিনারা।মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শ্রীপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এস আই) আমজাদ শেখ জানান, শেফালীর সংসারে টাকার দরকার হলে বিষয়টি মা মিনারাকে জানান। বাবার কাছ থেকে পাওয়া প্রায় ৯ শতাংশ জমি ও দুইটি গরু বিক্রি করে টাকা দেওয়ার জন্য মিনারা বেগমকে চাপ দেয় শেফালী। এতে মিনারা বেগম রাজি না হওয়ায় শেফালীর সাথে মিনারার বাকবিতন্ডা হয়। মিনারা রাগ করে চড় থাপ্পড় মেরে শেফালীকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এতে শেফালী ক্ষুব্ধ হয়ে মা মিনারা বেগমকে হত্যার পরিকল্পনা করে। মাকে হত্যার জন্য তার সহকর্মী সোহেল রানাকে বিষয়টি জানায়। মিনারাকে হত্যা করতে ১ লাখ টাকা দাবি করেন সোহেল রানা। এতে শেফালী রাজি হয়ে সোহেলকে ১৫ হাজার টাকা অগ্রীম দেন এবং বাকি ৮৫ হাজার টাকা কাজ শেষে দেবে জানিয়ে তারা মিনারাকে হত্যার পরিকল্পনা করে।পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১০ ফেব্রুয়ারি শেফালী তার মা মিনারাকে বন ওয়াজ মাহফিলে ওয়াজ শোনার কথা বলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মায়ের বাড়ি থেকে বের হয়। শেফালী তার মাকে নিয়ে কেওয়া এলাকার সিআরসি মোড়ে সোহেলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এরপর সোহেল আসলে মা ও মেয়েসহ তিনজন একটি অটোরিক্সা ভাড়া করে ওয়াজ শোনার কথা বলে উপজেলার বরমীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথে সোহেল একটি সেভেন আপের (কোমল জাতীয় পানি) মধ্যে কিছু চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে মিনারাকে খেতে দেন। সেটি খাওয়ার পর মুহুর্তেই মিনারা অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর তারা বরমীর ভিটিপাড়া গ্রামের সাধুখার টেক এলাকার গভীর জঙ্গলের কাছে পৌঁছে অটোরিক্সাকে ছেড়ে দেয়। রাত সাড়ে ৮টার দিকে জঙ্গলের ভেতর নিয়ে শেফালী ইট দিয়ে তার মায়ের মাথায় আঘাত করে। তারপর শেফালী তার মাকে মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে বুকের ওপর বসে দুই হাত দিয়ে মাথা ও গলা টান দিয়ে ধরলে সোহেল ছুরি দিয়ে জবাই করে। এরপর মিনারার মৃত্যু নিশ্চিত হলে সোহেল ঘটনাস্থলে পাশের একটি পুকুরে ছুরিটি ফেলে দিয়ে চলে আসেন। কালিয়াকৈর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আজমীর হোসেন বলেন, সামান্য বিষয় নিয়ে মেয়ে তার মাকে হত্যা করতে পারে এমন ধারণাই ছিল না পুলিশের। দীর্ঘ তদন্ত শেষে পুলিশ একটি ক্লুলেস হত্যা মামলার রহস্য সফলভাবে উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে।