গাজীপুরের শ্রীপুরে গত এক যুগ ধরে শিকলবন্দী জীবন কাটাচ্ছে শামসুল আরেফীন ওরফে কায়সার হামিদ। সে শ্রীপুরের লোহাগাছ গ্রামের মো. লুতফুল্লাহ খানের ছেলে। জন্মের আড়াই বছর পর থেকে অন্য শিশু থেকে ব্যাতিক্রম আচরণ দেখে বাবা-মা প্রতিবন্ধী হিসেবে তাকে চিহ্নিত করেন। আর তখন থেকেই তার বন্দি জীবন শুরু হয়।
বাবা লুতফুল্লাহ খান বলেন, কায়সার তার বড় সন্তান। আড়াই বছর বয়স থেকে অন্য শিশুদের চেয়ে ব্যাতিক্রম আচরণ শুরু করে। কথা বলতে পারে না, বাবা-মা’সহ অন্য শিশুদের মারধোর করে। সমস্যার জন্য প্রথমে কবিরাজ সুস্থ করার চেষ্টা করি। কোনো উন্নতি না দেখে শিশু হাসপাতাল ও পরে মনোরোগ চিকিৎসার শরণাপন্ন হই। শিশু সন্তানটিকে চিকিৎসকদের পরামর্শে প্রতিদিন ১২টি করে ট্যাবলেট খাইয়েছেন। তারপরও সুস্থ করে তুলতে পারেননি।
বাবা লুফুল্লাহ জানান, এদিকে তাঁর বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাবা-মা, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পাশাপাশি প্রতিবেশী শিশুদেরও মাধোর শুরু করে কায়সার। নিজ বাড়ি ও প্রতিবেশীদের গাছপালা কেটে ফেলাসহ নানা ধরনের উৎপাত করতে থাকে। নিজ হাতে তুলে কিছু খেতে চায়না।
কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সাত বছর বয়স থেকে প্রথমে রশি ও পরে পায়ে শিকল লাগানো হয়। এরপর অনিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেয়া শুরু করে। ঘরবাড়িসহ আশপাাশের পরিবেশ নোংরা করতে থাকে। শীত কিংবা গরম কোনো ঋতুতে গায়ে কাপড় রাখতে চায় না। এর এক পর্যায়ে আলাদা থাকার ঘর করে দেয়া হয়। ১২ বছর চলছে শিকল পরানো পায়ে একাকী জীবনযাপন করছে কায়সার হামিদ।
তার বাবা লুতফুল্লাহ বলেন, তিনি নিজেই ছেলে কায়সার হামিদের মুখে খাবার তুলে দিতেন। কিন্তু খাবারের প্রতি ধ্যান খেয়াল না করে আশপাশের পরিবেশ নোংরা করে ফেলে। এতে ধৈর্য হারিয়েে ফেলেন বাবা লুতফুল্লাহ। এজন্য গত চার বছর আগে থেকে মায়ের হাতেই খাবার উঠে কায়সারের মুখে। আচার আচরণে নিজের পরিবেশ বিনষ্টের কারণে রাতে তার ঘরেও শিকলবন্দী করে রাখা হয়। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে বাড়ির বাইরে এনে সেখানেও শিকলবন্দী করে রাখা হয়। এভাবেই চলছে শিশু কায়সার থেকে তরুন কায়সারের শিকলবন্দী জীবন।
প্রতিবেশী আসাদুল হক বলেন, কায়সার হামিদকে কমপক্ষে ১৭ বছর যাবত প্রতিবন্ধী হিসেবে দেখছেন। গায়ে কাপরচোপড়র রাখে না, গাছপালা কেটে ফেলে। তার বাবা লুতফুল্লাহ নৈশ প্রহরীর কাজ করে ছেলেকে চিকিৎসা করিয়েছে। কিন্তু তাতে কোন ফল হয়নি।
প্রতিবেশী নাঈম ইসলাম বলেণ, পাঁচ বছর বয়স থেকে বাকপ্রতিবন্ধী ও মৃগী রোগী হিসেবে তাকে চেনেন। দরিদ্র বাবা বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা করিয়ে কোনো ফল পায় নি। দুই ছেলে ও তিন কন্যাসহ সাত সদস্যের পরিবারে বাকপ্রতিবন্ধী ছেলে ভরনপোষন করতেও এখন হিমশিম খাচ্ছেন বাবা লুতফুল্লাহ। প্রতি মাসে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ছেলের জন্য সাড়ে তিন’শ করে টাকা ভাতা পান। কিন্তু এর দ্বিগুণ খরচ হয় প্রতিবন্ধী ছেলের মাসিক চিকিৎসা কাজে।
কায়সাওরের নানা আব্দুর রহিম মীর বলেন, মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে মানুষের জীবনের স্বাদ পায়নি কায়সার হামিদ। তার পরিবারও তার পেছনে সময় দিতে গিয়ে এখন জীবনের স্বাদ নেওয়র সুযোগ থেকে বি ত হচ্ছে।
শ্রীপুর পৌরসভার স্থানীয় (৩ নম্বর ওয়ার্ড) কাউন্সিলর আব্দুস সাহিদ সরকার বলেন, আমরা ছেলেটির জন্য অনেক আগে থেকেই প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করেছি। সরকার অথবা সমাজের বিত্তশালী কোনো ব্যাক্তি ছেলেটির উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে হয়তো তরুন ছেলেটি তার জীবনের স্বাদ পেত এবং পাশাপাশি তার পরিবারের দু:খ কষ্ট লাঘব হতো।
শ্রীপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, অসুস্থ কায়সার হামিদের জন্য সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। তাকে দেখতে গিয়েছিলাম কিন্তু শিকল পরানো পাইনি। এরকম হলে পরিবারের সদস্যদের বুঝাতে হবে। তারপরও সরকারি তরফ থেকে কোনো সহযোগিতার সুযোগ থাকলে তা করা হবে।