বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিয়ে শঙ্কা গভীর হচ্ছে। দুর্ভিক্ষের শঙ্কাও রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), আইএমএফ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিসহ বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস আগামী দিনে খাদ্য নিয়ে সংকটের বার্তা দিচ্ছে। এর বাইরে নেই বাংলাদেশ। এফএওর হালনাগাদ এক প্রতিবেদনে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হুমকিতে থাকা বিশ্বের ৪৫টি দেশের তালিকায় নাম রয়েছে বাংলাদেশের। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক জরিপে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত, জ্বালানি সংকটসহ নানা কারণে ক্রমে জটিল রূপ নিচ্ছে খাদ্য সরবরাহ চেইন ও মূল্য পরিস্থিতি। বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটেছে সার ও কৃষিপণ্যের সরবরাহ চেইনেও। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় অভ্যন্তরীণ নানা কারণ এ সংকট আরও বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ও খাদ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাযথ প্রস্তুতি নিলে বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাব তুলনামূলক কম পড়বে।
খাদ্য সংকট ও নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কার এমন প্রেক্ষাপটে আজ রোববার পালিত হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস। ‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়, ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন’ স্লোগানে বাংলাদেশে বিভিন্ন সংগঠন আজ দিবসটি পালন করছে। আগামীকাল সোমবার কৃষি মন্ত্রণালয় এ দিবস পালনের জন্য কর্মসূচি নিয়েছে। ওই দিন সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্ত থাকার কথা রয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁরা খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলায় কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দা ও খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। দেশে যাতে দুর্ভিক্ষ না হয়, সে জন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন।
কারা কী বলছে: জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ক্রপ প্রসপেক্টস অ্যান্ড ফুড সিচুয়েশন’ শিরোনামে প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ৪৫টি দেশে ঘাটতিজনিত খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা এখন সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আছে ৯টি দেশ, যার মধ্যে বাংলাদেশসহ তিনটি দেশ দক্ষিণ এশিয়ার।
গত মে মাসে সিলেট অঞ্চলের বন্যায় বোরো ধানসহ ব্যাপক ফসলহানির শিকার হয়েছেন কৃষক। এফএওর হিসাব অনুযায়ী, ওই সময়ের বন্যায় অন্তত ৭২ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশে থাকা ১০ লাখ রোহিঙ্গা খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকি বাড়িয়েছে। ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেইজ ক্ল্যাসিফিকেশনের (আইপিসি) সম্প্রতি প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, দেশের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ এখন মধ্যম ও গুরুতর মাত্রার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যা মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হালনাগাদ ‘কমোডিটি মার্কেট আউটলুক’ অনুযায়ী বিশ্ববাজারে গত সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন ধরনের সারের দাম বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম কমলেও খাদ্য ও কৃষিপণ্যের দাম আগের দু’মাসের মতোই রয়েছে।
গত আগস্টে ডব্লিউএফপি পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে গত বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশ ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড ভালনারাবিলিটি মনিটরিং রিপোর্ট’ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে ২২ শতাংশ পরিবার মাঝারিমানের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আছে। নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে ৪২ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আছে এবং পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। এ ধরনের পরিবারে পুষ্টিরও অবনতি হয়েছে। অনেকেই পরিস্থিতি সামাল দিতে খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দিয়েছেন, যা পুষ্টির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষ খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের মূল্যস্ম্ফীতিতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত আগস্টে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ম্ফীতি ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে পৌঁছে। সেপ্টেম্বরে খানিকটা কমলেও তা ৯ শতাংশের বেশি আছে। উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান হলো, গ্রামে মূল্যস্ম্ফীতি শহরের চেয়ে বেশি।
সম্প্রতি কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (জিএইচআই) এ বছর ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬ থেকে ৮৪তম স্থানে নেমে এসেছে। এ-সংক্রান্ত সূচকেও বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে। ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ‘মাঝারি মাত্রার’, যা ‘গুরুতর’ অবস্থার কাছাকাছি। সূচক ২০ থেকে ৩৫-এর মধ্যে থাকলে পরিস্থিতি ‘গুরুতর’। বাংলাদেশের সূচক ১৯ দশমিক ৬, যা ‘গুরুতর’ অবস্থার সামান্য নিচে।
একদিকে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা; অন্যদিকে সেচের বাড়তি খরচ, সারের দাম, শ্রমিকের বাড়তি মজুরির কারণে এবারে আমনের উৎপাদন খরচ ৩৯ শতাংশ বেড়ে যাবে বলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) গবেষণায় উঠে এসেছে। এ অবস্থায় আমন মৌসুমের ফলন উঠলেও চড়া দামেই ভোক্তাকে চাল খেতে হতে পারে বলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক ও কৃষি অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
দাম, মজুত ও আমদানি পরিস্থিতি: আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের খাদ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে অস্বাভাবিক বেড়েছে গমের দাম। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) গড়ে প্রতি টন গমের (ইউএস এসআরডব্লিউ) দাম ছিল প্রায় ৩১৬ ডলার। চালেরও দাম বাড়তি। গড়ে প্রতি টন চালের (সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ভাঙা) দাম ছিল ৪১৪ ডলার। অথচ গত বছরের একই সময়ে প্রতি টন গমের দাম ২৬৪ ডলার এবং চালের দাম ছিল ৪০৪ ডলার।
খাদ্যশস্য উৎপাদনে ব্যবহূত বিভিন্ন সারের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন ইউরিয়া সার গড়ে ৬২৩ ডলারে কেনাবেচা হয়েছে। গত বছরের এই সময় প্রতি টনের দাম ছিল ৪৩৫ ডলার, অর্থাৎ এক বছরে টনপ্রতি দাম বেড়েছে ১৮৮ ডলার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে প্রায় ৫৭ লাখ টন রাসায়নিক সারের দরকার হবে। দেশে উৎপাদন হয় ১০ লাখ টনের মতো। বাকি ৪৭ লাখ টন আমদানি করতে হবে।
এদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বাড়ার কারণে ব্যবসায়ীরাও আমদানিতে সাহস পাচ্ছেন না। সরকার দুই ধাপে সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে শুল্ক্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনলেও কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে আমদানি হয়নি। চলতি অর্থবছর এ পর্যন্ত বেসরকারিভাবে সাড়ে ১৩ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও এসেছে দুই লাখ টনের কিছু বেশি। তবে গম আমদানি তুলনামূলক বেশি। সরকারি-বেসরকারিভাবে গম আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ১৬ হাজার টন। চলতি অর্থবছরে শস্য এবং শস্যজাতীয় পণ্য আমদানি করতে হবে এক কোটি টন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ১২ অক্টোবর পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে ১৬ লাখ ৬৯ হাজার টন, যা গত আগস্টে ছিল ১৭ লাখ ৫০ হাজার। খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন সমকালকে বলেন, এরই মধ্যে বেসরকারিভাবে তিন লাখ টন চাল এসেছে। আরও তিন-চার লাখ টন আসতে পারে। সরকারিভাবে সাড়ে পাঁচ লাখ টন আমদানির জন্য চুক্তি হয়েছে। এরপরও লাগলে সেটা সরকার বিবেচনা করবে। বেশি পরিমাণে খাদ্যশস্য সংরক্ষণাগারের জন্য সারাদেশে আটটি সাইলো নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সব সাইলো স্থাপন হলে আরও তিন থেকে চার লাখ টন খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করা যাবে।