আন্তর্জাতিক ডেস্ক :সুদান সরকারের নির্দেশে বিমান বাহিনী নির্বিচারে দারফুরের বহু গ্রামে বোমা হামলা শুরু করলো। অন্যদিকে জানজাউইদরা ঘোড়ায় চড়ে একেকটি গ্রামে আক্রমণ করতো ও সব বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিত। অন্যদিকে ভূমিতে জানজাউইদ ও উপসামরিক ফোর্সের আক্রমণ তো চলছিলই। এরপর সেই বছরের সেপ্টেম্বরে বিদ্রোহী দল ও সরকারের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত হয়। তবুও জানজাউইদদের আক্রমণ থেমে থাকেনি।
কিন্তু ডিসেম্বরের দিকে যুদ্ধবিরতি ভেস্তে যায়। বিদ্রোহীদের সাথে সংঘাত নতুন মাত্রায় আবার শুরু হয়। কিন্তু পাশাপাশি অকল্পনীয় হারে জানজাউইদরা আফ্রিকান উপজাতিদের গ্রাম পুড়িয়ে দেয়, পুরুষদের হত্যা ও পঙ্গু করে দেয়, খাবার সরবরাহ রোধ করে এবং আন্তর্জাতিক কোনো সহায়তা যাতে পৌঁছাতে না পেরে সেজন্য অবরোধ করে রাখে। জানজাউইদরা শরণার্থী শিবিরেও আক্রমণ চালায় এবং আরো একটি নিকৃষ্ট ব্যাপার হচ্ছে তারা নারীদের নির্বিচারে ধর্ষণ করে। এই পুরো নৃশংসতা তারা খুবই নিয়মানুগভাবে করেছে। সুদানের বিভিন্ন অধিকার বিষয়ক কর্মীরা একে সরকারের আদেশ অনুযায়ী একটি সুগঠিত ও পরিকল্পিত জাতিগত নির্মূল প্রক্রিয়া হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। ২০০৪ সালের শুরুর দিকেই প্রায় এক লাখের বেশি মানুষ নিজেদের জায়গা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ চাদে শরণার্থী হিসেবে চলে যায়। ২০০৪ এর এপ্রিলে আবারো একটি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। তবে সরকার পক্ষের সশস্ত্র দলগুলোর অন্যায়-অত্যাচার ও নৃশংসতা বন্ধ হয়নি।
২০০৪ সালের মে মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দারফুরে সংঘটিত ঘটনাগুলোর তথ্য সম্বলিত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তারা যদিও একে গণহত্যা না বলে জাতিগত নির্মূল বলছে, তবে তাদের রিপোর্টে যে তথ্য উঠে এসেছে তা অকল্পনীয়। তারা সেই রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে, ফুর, যাঘাওয়া ও মাসালিত উপজাতি গোষ্ঠীর উপর তিনভাবে গণহারে হত্যাকান্ড চালানো হয়েছে। একটি হচ্ছে সেনাবাহিনী ও জানজাউইদ সেসব জায়গায় গিয়ে পুরুষদেরকে বিচার বহির্ভূত উপায়ে হত্যা করেছে, আরেকটি হচ্ছে কোনো আক্রমণে সেনাবাহিনী ও জানজাউইদ একসাথে পাশাপাশি অংশ নিয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্র সাথে নিয়ে জানজাউইদদেরকে সুরক্ষা দেয়ার চেষ্টা করেছে যেহেতু জানজাউইদরা ভারী অস্ত্র ব্যবহার করতো না। সেনাবাহিনী জানজাউইদদেরকে থামানোর চেষ্টা করছে এমন কোনো নজির দেখতে পাওয়া যায়নি। বিদ্রোহীরা যেখানে অবস্থান করছে এমন জায়গায় তারা সাধারণত আক্রমণ না করে নিরপরাধ উপজাতিদের গ্রামে আক্রমণ করতো যেন তাদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে সেসব মানুষদেরকে নির্মূল করার মাধ্যমে সেসব জায়গায় আরবীয় উপজাতিদের স্থান করে দেয়া। এমনও দেখা যেত তারা একই গ্রামে বারবার আক্রমণ চালাচ্ছে এবং আগুন লাগিয়ে সব বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি ধর্ষণ ও লুটতরাজ তো ছিলই।
দারফুরে সংঘটিত ঘটনাগুলো ব্যাপক নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরেছে, যার ফলে প্রায় ৪০০টির মতো গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যাপক হত্যাকান্ড, বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করা, ধর্ষণ, অপহরণ সবকিছু মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ অনেক। অপরাধগুলোর ধরণ অনুসারে একে গণহত্যা বলা হয়েছে। এক বছরের মধ্যে প্রায় ১-৪ লাখের মতো মানুষ মারা যায় এবং ২০ লাখ মানুষ দারফুর ছেড়ে পালিয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। একে সেই সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট আখ্যা দেয়া হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই সংকট এখনো বিদ্যমান।
২০০৪ সালের ২২ মার্চ সুদানে জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয়কারী মুকেশ কাপিলা একটি কথা বলেছিলেন, “সুদান আর রুয়ান্ডার মধ্যে এখন একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে সংখ্যার দিক থেকে।” অর্থাৎ তিনি রুয়ান্ডায় যা দেখেছিলেন তার একই চিত্র সুদানেও দেখছেন। পার্থক্যটা শুধু হতাহতের সংখ্যায়। তার মতে, সুদানে যা হয়েছে তা কেবল একটি সংঘাত নয়। একটি দল সুসংগঠিত উপায়ে আরেকটি দলকে সরিয়ে ফেলতে চাচ্ছে। রুয়ান্ডার মতো সুদানেও কাপিলা গণহত্যার আলামত দেখতে পেয়েছেন। ২০০৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট কলিন পাওয়েল সুদানে সংঘটিত নৃশংসতাকে গণহত্যা হিসেবে ঘোষণা করেন এবং এই গণহত্যার জন্য দায়ী হচ্ছে সুদানের সরকার ও জানজাউইদ।