জেমস আব্দুর রহিম রানা যশোর প্রতিনিধি দৈনিক শিরোমণিঃ যশোরের মণিরামপুর উপজেলায় সর্বত্র বাঁশ ও বেত শিল্প আধুনিকতার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে চাহিদা মেটাতে মানুষ একদিকে ঝুঁকে পড়েছে প্লাস্টিক, টিন ও স্টিলের পণ্যের দিকে। ফলে অন্যদিকে বেকার হয়ে পড়ছে এ শিল্পের সাথে জড়িত বাঁশ এবং বেত শিল্পীরা।সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, খুব বেশিদিনের আগের কথা নয়, এমন কোন পরিবার ছিল না যে, তারা বাঁশ ও বেতের তৈরি ডালি, ডাঙ্গারী, বসার মোড়া, মাচা, কাপড়া, ধামা, চালুন, ঝাড়–নি, খালই, খৈই চালা, ফুলের খাঁচা, ছাকনা, ঝুড়ি, কুলা, মাছ ধরা পলো, পালার টোপাসহ বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জামাদি সংসারের কাজে ব্যবহার করতো না। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকায় কম বেশি বাঁশ দেখা গেলেও বেতের ঝোপঝাড় নজরে খুব কমই পড়ে থাকে। বাজারে গিয়ে বাঁশ কম-বেশি দরে ক্রয় করা গেলেও বেত মেলানো খুবই কষ্টদায়ক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় যে পরিমান বেত খুঁজে পাওয়া যায় তার বাজার মুল্যও বেশি। যে কারণে অনেক পরিবার বাঁশের কাজ টুকিটাকি করলেও বেতের কাজ প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। বর্তমান সময়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার লাভ করায় লোকজন সাংসারিক ও দৈনন্দিন কাজে বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসের পরিবর্তে প্লাস্টিক, সিলভার, স্টিল, এলোমুনিয়াম ও ম্যালামাইনসহ বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম দিয়ে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে এর প্রভাবে ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে বাঁশ ও বেত শিল্পীরা পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকটাই মানবেতর জীবন-যাপন করছে।মণিরামপুর ঋষিপাড়ার বাঁশ ও বেত শিল্পী গোপাল কৃষ্ণ বৈরাগী (৬৫) জানান, বাপ-দাদার পৈত্রিক পেশা হিসেবে জন্মগতভাবে এ কাজের সাথে জড়িত আছি। অতীতে বাঁশ ও বেতের কোন অভাব ছিল না। অনেক পরিবার তাদের বাড়ির আশেপাশের ঝোঁপঝাড় পরিষ্কার করার জন্যও বাঁশ ও বেত বিনামূল্যেই দান করত। তখন হাতের তৈরি এসব জিনিসপত্রের বেশ কদরও ছিল। বাজারে বিক্রি করে যা উপার্জন হত তা দিয়ে সংসার খুব ভাল ভাবেই চলে যেত। কিন্তু বর্তমানে এ পেশা প্রায় ছেড়ে দেয়ার পথে। পুত্র সন্তানরা সবাই এ পেশা ছেড়ে দিয়ে কেউ সেলুনে চুল কাটার কাজ করে, কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজানোর কাজ করে সংসার চালাচ্ছে। বাড়ির মহিলারা শুধুমাত্র জাত পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছে। মণিরামপুর উপজেলা খানপুর ঋষিপাড়ার নারায়ন চন্দ্র জানান, আমার পিতা-মাতা এক সময় বাঁশ ও বেতের কাজ করতেন। কিন্তু আমরা এ কাজে কোন উন্নতি না পেয়ে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছি। চাঁদপুর গ্রামের ঋষিপাড়ার সাধন দাস ও মুকুন্দ দাস জানান, আমাদের পাড়ায় প্রায় ৩০ টি পরিবারের ১৮০ জন লোক এখানে বসবাস করছেন। বর্তমানে এ পাড়ায় শতকরা ৩০ জন লোক লেখাপড়া করে থাকে। এক সময় প্রতিটি পরিবারের সকল সদস্যই এ পেশায় জড়িত ছিলেন। কিন্তু এখন আর অনেকেই এই পেশায় জড়িত নেই। কেউ লেখাপড়া করেন, কেউ অন্য ব্যবসা, কেউ সেলুনে চুল কাটেন। আবার কেউ কেউ পৈত্রিক পেশাকে এখন পর্যন্ত আঁকড়ে ধরে আছেন। যেসব পরিবার এখনও পৈত্রিক পেশাকে ধরে রেখে বাঁশ ও বেঁতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে তারা হয়তো আর বেশিদিন এ পেশাকে ধরে রাখতে পারবেন না। কারণ বাঁশ ও বেতের উচ্চমূল্যের পাশাপাশি শ্রমিকের মজুরি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া এ কাজে সরকারিভাবে কোন সহযোগিতাও পাওয়া যায় না। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ শিল্পকে অদূর ভবিষ্যতে বাঁচিয়ে রাখা আদৌও সম্ভব নয়।
১১ views