মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় ব্যবহার করে বিলিয়ন ডলারের ডিজিটাল হুন্ডি কারবার করা ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডি জানিয়েছে, দেশের ডলারের দাম বৃদ্ধির নানা কারণে তদন্ত শুরু করে সিআইডি। তদন্তে সিআইডি জানতে পারে, গত এক বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ৭.৮ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা।বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া।
তিনি বলেন, যে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে গত ৪ মাসে ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা পাচার হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও সিআইডি ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করে জানতে পারে এমএফএসের মাধ্যমে হুন্ডি করে এমন ৫ হাজারের বেশি এজেন্টের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি।
তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা জানতে পারি তারা বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়ের মাধ্যমে এমএফএস এজেন্ট জড়িত বলে পাওয়া গেছে। এই ৫ হাজার এজেন্ট গত ৪ মাসে ২৫ হাজার কোটি এবং বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে।
সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া আরও বলেন, রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ। সাম্প্রতিক বিশ্ব পরিস্থিতি এদেশের অর্থনীতির উপর যে চাপ তৈরি করেছে তা মোকাবিলা করার জন্য সরকার অত্যন্ত তৎপর। হুন্ডি সবসময় রিজার্ভের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর এই ঝুঁকি মোকাবেলায় সিআইডি হুন্ডি কার্যক্রমের উপর নজরদারি শুরু করে। অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানা যায় যে একটি সংঘবদ্ধ চক্র অবৈধভাবে হুন্ডির মাধমে বিদেশে অর্থপাচার এবং বিদেশে অবস্থানরত ওয়েজ আরনারিদের কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে না এনে স্থানীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করার মাধ্যমে মানি লন্ডারিং অপরাধ করে আসছে।
তিনি বলেন, সংঘবদ্ধ হুন্ডিচক্র প্রবাসে বাংলাদেশীদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে তা বাংলাদেশে না পাঠিয়ে উক্ত বৈদেশিক মুদ্রার সমপরিমাণ মূল্যে স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করে। এ কাজে অপরাধীরা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজটি করে থাকে।
প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে, দেশ থেকে যারা টাকা পাচার করতে চায় তাদেরকে দেয়। দ্বিতীয় গ্রুপ পাচারকারী ও তার সহযোগীরা দেশীয় মুদ্রায় এই অর্থ এমএফএস এজেন্টকে প্রদান করে। তৃতীয় গ্রুপ তথা এমএফএস এজেন্টরা বিদেশে অবস্থানকারীর কাছ থেকে প্রাপ্ত মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস নম্বরে দেশীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করে।
এসব চক্র প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে এমএফএস ব্যবহার করে ক্যাশ ইনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হুন্ডি করছে। এমএফএস এজেন্টদের সহযোগিতায় পাচারকারীরা বিদেশে স্থায়ী সম্পদ অর্জনসহ অনলাইন জুয়া, মাদক কেনাবেচা, স্বর্ণচোরাচালান, ইয়াবা ব্যবসাসহ প্রচুর অবৈধ ব্যবসাও পরিচালনা করছে।
সিআইডি প্রধান বলেন, এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড দেশী ও বিদেশী মুদ্রাপাচার মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ২(শ) (১৪) ধারা অনুযায়ী অপরাধ। যা একই আইনের ৪(২) এর ধারায় দন্ডনীয়। এ বিষয়ে মামলা রেকর্ডসহ যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
আটকরা হচ্ছেন- আক্তার হোসেন (হুন্ডি এজেন্ট), দিদারুল আলম সুমন (হুন্ডি এজেন্ট), খোরশেদ আলম ইমন (হুন্ডি এজেন্টের সহযোগী), রুমন কান্তি দাস জয় (বিকাশ এজেন্ট), রাশেদ মাঞ্জুর ফিরোজ (বিকাশ এজেন্ট), মোঃ হোসাইনুল কবির (বিকাশ ডিএসএস), নবীন উল্লাহ (বিকাশ ডিএসএস), মোঃ জুনাইদুল হক (বিকাশ ডিএসএস), আদিবুর রহমান (বিকাশ ডিএসও), আসিফ নেওয়াজ (বিকাশ ডিএসও), ফরহাদ হোসাইন (বিকাশ ডিএসও), আবদুল বাছির (বিকাশ এজেন্ট), মাহাবুবুর রহমান সেলিম (বিকাশ এজেন্ট), আবদুল আউয়াল সোহাগ (বিকাশ এজেন্ট) ও ফজলে রাব্বি (বিকাশ এজেন্ট)।
তাদের কাছ থেকে নগদ ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৬৮০ টাকা, ৪টি সিমে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ৪৭ হাজার ২২৯ ইলেকট্রনিক মানি ও ৩৪টি মোবাইল উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মোট ৪টি মামলা করেছে সিআইডি।
ডলারের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কেন অভিযান চালিয়ে এদেরকে গ্রেপ্তার করা গেল না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত না পাওয়ার কারণে ধরা যায়নি। সিআইডির গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা তথ্য মিল পাওয়ার ভিত্তিতে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বাংলাদেশ সরকার বিভিন্নভাবে প্রণোদনা দিচ্ছে এর পরেও বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা না পাঠিয়ে অবৈধভাবে কেন বাংলাদেশিরা টাকা পাঠাচ্ছে এই প্রশ্নের জবাবে সিআইডি প্রধান বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে আমাদের একটি মিটিং হয়েছে। আমার বিশ্বাস এর একটি সুষ্ঠু সমাধান হবে।
সিআইডি ৫ হাজার মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস এজেন্টকে শনাক্ত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এজেন্ট অবৈধ কার্যক্রম করছে। আমরা টার্গেট করে তিনটি গ্রুপকে ধরেছি। ইতিমধ্যে যারা অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল সিআইডির তৎপরতায় সেখান থেকে তারা সরে আসতে শুরু করেছে। আমরা ইন্টেলিজেন্স বেইজ অপারেশন পরিচালনা করি। সিআইডি ৫ হাজার মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এজেন্টদের নজরদারির মধ্যে রেখেছে। দু’একদিনের মধ্যে অবৈধভাবে লেনদেন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কমে যাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিকাশ, রকেট, নগদ ছাড়াও যেসব মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস রয়েছে তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে মিটিং করিনি। আনুষ্ঠানিকভাবে মিটিং না করার কারণ ইন্টেলিজেন্স যাতে ফাঁস না হয়।
লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি সৌদি আরবে কাজ করেন। তাদের টাকাগুলো ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে এলে দেশের রিজার্ভ অনেক ভারি হতো। কিন্তু সৌদিতে এজেন্ট আছে। ওই দেশের এজেন্টরা বাংলাদেশি এজেন্টদের কাছে কথা বলে হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধভাবে টাকা পৌঁছে দিচ্ছে। তবে এটি খুব শিগগিরই বন্ধ হয়ে যাবে এবং দেশের রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে।
সিআইডিতে অনেক মামলার তদন্তের জট রয়েছে। মামলার জট কমাতে আপনি কি ভূমিকা পালন করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১৪৫টির মতো মামলা সিআইডিতে এখন রয়েছে। যা পাঁচ বছর আগের। বেশিরভাগ মামলাই হাইকোর্টের আদেশ থাকে। আমি নির্দেশনা দিয়েছি দুই বছরের অধিক যেন কোনো মামলা না থাকে এবং এক বছরের মধ্যে সব মামলার কাজ শেষ করতে হবে।
হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো টাকা জঙ্গিবাদে কোনো কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সিআইডি প্রধান বলেন, তদন্ত করে দেখা হবে বিষয়টি।