মঈনুল হাসান রতন,হবিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধিঃ একটা সময় ছিল যখন বড় বড় নৌকা পাল তুলে উড়ে যেত লাখাইয়ে অবস্থিত সুতাং নদী দিয়ে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না। নদীর আকাবাঁকা পথ যেন এখন মৃত প্রায়। উজান থেকে নেমে আসা শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে এক সময়ের সুতাং এখন লাখাই বাসির দুঃখ হয়ে দাড়িয়েছে। লোকমুখে শোনা যেত সুতাং নদীতে ধরা পাড়া বড় বড় মাছের গল্প। কিন্তু সেই গল্প এখন কেবলই গল্প। বাস্তবে নেই এর ছিটেফোটাও। নদীতে ক্রমাগত বর্জ্য পড়ার কারণে পানি চিটা হয়ে কালো রং ধারণ করে অনেকটা তারতেলের মত হয়ে গেছে। আর এতে করে অস্থিত্ব বিলীনের পথে রয়েছে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী এই নদীটি। তাই নদীটির হারোনা ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন নদীপাড়ে বসবাস করা হাজারো ভোক্তভোগী। সুতাং নদীটি বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এর দৈর্ঘ্য ৮২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৬ মিটার এবং প্রকৃতি সর্পিলাকার। সুতাং নদী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে উৎপত্তি লাভ করে জেলার চুনারুঘাট উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারপর লাখাই উপজেলা দিয়ে কালনী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়।সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে অলিপুর এলাকায় অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় শতাধিক কল কারখানা। কারখানাগুলোতে বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) ব্যবহার করা কথা থাকলেও বেশির ভাগ কারখানায়ই তা মানছেন না। আবার যে কয়েকটি কারখানায় ইটিপি রয়েছে তা নামে মাত্র। অতিরিক্ত খরচের ভয়ে নিয়মিত চালানো হচ্ছে না ইটিপি। ফলে পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনকে রীতিমত বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে তারা। কারখানাগুলোর ক্রমাগত বর্জ্যই এখন কাল হয়েছে নদী পাড়ের বাসিন্দাদের। কৃষকরা জানান, সুতাং নদীর পানি ব্যবহার করে লাখাই উপজেলার প্রায় ১০ হাজার হেক্টর বোরো জমি চাষাবাদ করা হয়। কিন্তু এখন নদীর পানি ব্যবহার তো দুরের কথা নদীর পাড়েও যাওয়া যায় না দুর্গন্ধের কারণে। গরু, ছাগল, হাস মুরগি নদীর পানিতে নামলে মারা যাচ্ছে। মানুষের শরীরে লাগলে হচ্ছে চর্ম রোগ। এমতাবস্থায় সীমাহীন ভোগান্তিতে রয়েছেন তারা। এছাড়াও বোরো জমিগুলো চাষ করতে এখন নিতে হচ্ছে বিকল্প ব্যবস্থা। গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে চাষ করতে হচ্ছে জমি। ফলে বাড়ছে কৃষকদের বাড়তি খরচ।স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, এক সময় সুতাং নদীর বেশ ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু এখন নদীর পাড় দিয়ে কেউ হেটেও যেতে চায় না। হেটে গেলেও নাকমুখে রুমাল দিয়ে যায়। নদীটির পানির অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে যে পানি কালো বর্ণ ধারণ করে তারতেলের মত হয়ে গেছে। তাই এ পানি এখন কৃষি কাজেও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে বিকল্প ব্যবস্থায় পানি উত্তোলনে একদিকে যেমন খরচ বাড়ছে অন্যদিকে আবার কারো কারো কৃষি জমি করার প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। সুশীল চন্দ্র দাস জানান, বর্তমান সময়ে সুতাং নদীটি এখন আমাদের গলার কাটা হয়ে দাড়িয়ে আছে। না পারছি পানি ব্যবহার করতে না পারছি জমি ছেড়ে দিতে। প্রশাসন যদি নদীটি ড্রেজিং করত তা হলে হয়তো কিছুটা হলেও নদীর স্বাভাবিক গতি ফিরত।বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জুল সোহেল বলেন, ‘অলিপুর এলাকার বেশ কিছু কোম্পানির বর্জ্যে দূষিত হয়ে পড়েছে সুতাং নদী। কৃষিকাজে সেচ ব্যবস্থার নামে শৈলজুড়া নামক খালটি জেলা প্রশাসন ২০১৪ সালে পুনঃখনন করে প্রাণ-আরএফএল ও স্কয়ার কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া হয়। ফলে ঐ কোম্পানীগুলোর বর্জ্য সহজেই খালের মাধ্যমে সুতাং নদীতে ছাড়া হচ্ছে। যে কারণে শিল্পবর্জ্য দূষণে সুতাং নদীটি হয়ে পড়েছে মৎস্যশূন্য। নদীর পানি ব্যবহারকারীরা পড়েছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। তাই আমরা চাই এ বিষয়ে যেন প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহন করে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, সুতাং নদীর এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য জেলা প্রশাসন উদ্যোগ গ্রহন করেছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। একই সাথে তাদেরকে কঠোর ভাবে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। প্রশাসনের এমন অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।এদিকে, সুতাং নদী পুনরুদ্ধারে নোটিশ প্রদান করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। গতকাল মঙ্গলবার ‘নোটিশ অব ডিমান্ড ফর জাষ্টিস’ শিরোনামে বেলার আইনজীবি এডভোকেট সাঈদ আহমেদ কবীর রেজিস্ট্রিকৃত ডাকযোগে সচিব ভূমি মন্ত্রনালয়, সচিব পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রনালয়, সচিব নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়, সচিব পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় ও সিলেট বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে এ নেটিশ প্রদান করেন। এছাড়াও এর অনুলিপি প্রদান করা হয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন চেয়ারম্যান, মহাপরিচালক পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক হবিগঞ্জ ও পুলিশ সুপার হবিগঞ্জের কাছে। নোটিশে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) অত্র নোটিশের মাধ্যমে হবিগঞ্জ জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত “সুতাংনদী” রক্ষার্থেনিম্নলিখিত বিষয়ে কার্যকরী প্রতিকার চেয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। বেলার নোটিশটি তুলে ধরা হল * বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত “বাংলাদেশের নদ-নদী” নামক প্রকাশনা অনুযায়ী সুতাং নদী ভারত হতে উৎপন্ন হয়ে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দেওরগাছি ইউনিয়ন দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ৮২ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীহবিগঞ্জ সদর, লাখাই এবং চুনারুঘাট উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লাখাই উপজেলার লাখাই ইউনিয়নে কুশিয়ারা নদীতে পতিত হয়েছে।* একসময় এ নদী এলাকাবাসীর যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিল। বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে নৌ-চলাচল না করলেও বর্ষা মৌসুমে নৌকা ও ট্রলার চলাচল করে থাকে। বোরো মৌসুমে এ নদীর পানি ব্যবহার করে কৃষিকাজ সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। সনাতন ধর্মের লোকজন এক সময় এ নদীতে পুণ্যস্নান করতেন। প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হতো বেলেশ্বরী বান্নী। দেশের অন্যান্য নদীর মতো এ নদীর অবস্থাও সংকটাপন্ন। দখল, দূষণ, অবৈধ বালু উত্তোলনসহ নদী বিরুদ্ধ বহুমুখী ব্যবহারে এ নদীর অস্তিত্ব আজ সংকটাপন্ন।* সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে এ নদী দূষণের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার অলিপুর নামক স্থানে গড়ে উঠা শিল্পকারখানার বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে সুতাং নদী। অব্যাহত শিল্পবর্জ্যের দূষণে নদীটির পানি কালো বর্ণ ধারণ করেছে, পানি থেকে ছড়াচ্ছে দূর্গন্ধ, কষ্টকর হয়ে পড়েছে নদীর পাড় দিয়ে চলাচল এবং দূষণের কারণে মৎস্যশূন্য হয়ে পড়েছে নদীটি।* প্রকাশিত সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয় যে এ নদীর পানি দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত হওয়ায় এ নদীর অববাহিকায় বিদ্যমান বিস্তীর্ণ হাওরের বোরো ফসলের সেচকাজে ব্যবহার করতে পারছেন না কৃষক ফলে ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে। নদীর পানি ব্যবহারকারীরা পড়েছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ও আক্রান্ত হচ্ছে চর্মরোগসহ নানা অসুখে এবংমারা যাচ্ছে হাঁস, মুরগি ও গবাদিপশু।* দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী নদী দখল ও দূষণমুক্ত রেখে যথাযথ সংরক্ষণ করা আপনার/আপনাদের দায়িত্ব যা পালনে আপনি/আপনারা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।উপরোক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) হতে নি¤œস্বাক্ষরকারীঅত্র নোটিশের মাধ্যমে সুতাং নদী দখল ও দূষণকারী সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ তালিকা প্রস্তুতপূর্বক তা উচ্ছেদের জোর দাবি জানাচ্ছে। একইসাথে নদীটির প্রাথমিক প্রবাহ ও সিএস জরিপ (ক্ষেত্রবিশেষে আর এস) অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ করে সেখানে বালু উত্তোলনসহ নদী বিরুদ্ধ সকল কার্যক্রম বন্ধ ও নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে ড্রেজিংসহ প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবি জানাচ্ছে। সেইসাথে নদীটির বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় এনে নদীটিকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা ও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের অনুরোধ জানাচ্ছে। এছাড়াও এ বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ নোটিশ প্রেরণের ৭ (সাত) দিনের মধ্যে নিম্ন স্বাক্ষরকারীকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। অন্যথায় আপনার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।