ইসরায়েল রাস্টের পূর্বে জর্ডান পশ্চিমে মিসর বেস্টিত এ দেশটি ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। ইসরায়েলের দক্ষিণে রয়েছে বিশাল নেগেভ মরুভূমি আর উত্তরে আছে বরফাবৃত পর্বতমালা। দক্ষিণে লোহিত সাগরে আছে এক চিলতে প্রবেশপথ, যারপরনাই এমন ভৌগলিক অবস্থান নিয়ে এই রাস্ট্রের অবস্থান যা বর্তমান পৃথিবীর ভূ রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেকটাই কৌশলগত।
রাজধানী জেরুজালেম যাকে পবিত্র শহর বলেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান – বস্তুত এই তিন ধর্মের মানুষের বাস এই ভূখণ্ডে যাদের কাছে এই শহরের আলাদা ধর্মীয় মর্যাদা রয়েছে। ফলে ধর্মীয় দিক বিবেচনায়ও ইসরায়েল সমান গুরুত্বপূর্ণ বলেই ধরা হয়। অন্য সব ধর্মের মানুষের অবস্থান থাকলেও ইহুদিবাদী রাস্ট্র হিসেবে ইসরায়েল পরিচিত কারন এই ভূখণ্ডে ইসরায়েল রাস্ট্রের জন্মই হয়েছিল শুধুমাত্র ইহুদিদের বসবাসের জন্য ।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা কিভাবে এ বিষয়ে বলতে গেলে অনেক পেছনে চলে যেতে হয়। বলে রাখা ভাল, ইসরায়েল রাষ্ট্রটি স্বাধীন হয় কোনরুপ যুদ্ধবিগ্রহ করে নয় বরং জাতিসংঘের কন্সটিটিউশন এবং চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে। একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার, ইহুদিরা আসলে একটি নৃতাত্ত্বিক জাতি। ইহুদিদের আদি নিবাস বর্তমানের সিরিয়া-জর্ডান-লেবানন-ইসরাইল-ফিলিস্তিন অঞ্চল। কিন্তু ইতিহাসের নানা সময় নিপীড়নের শিকার হয়ে ইহুদিরা এই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয় এবং সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। উনবিংশ শতাব্দীতে অধিকাংশ ইহুদি বসবাস করত ইউরোপজুড়ে। বিশেষত জার্মান ও রুশ অঞ্চলে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে খ্রিস্টধর্মানুসারীদের সঙ্গে ইহুদিদের ওপর নতুন নিপীড়ক হিসেবে অবতীর্ণ হয় জাতীয়তাবাদীরা। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ইহুদি নেতারা তাদের আদি ভুখন্ডে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা শুরু করে। এর মূল লক্ষ ছিল ইহুদিরা তাদের আদি ভূখণ্ডে ফিরে যাবে।১৮৯৬ সালে ডঃ থিওডোর হারজেল প্রথম ইহুদী জাতিগোষ্ঠীর জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। ১৮৯৭ সালে ইহুদিদের আদি নিবাসে ফিরে যাওয়া ও তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র সৃষ্টির বিষয়টি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। ইউরোপের ইহুদীরা গড়ে তোলে জায়ানিস্ট সংঘ। জায়ানিস্ট সংঘ সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়, তাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ইহুদীদের জন্য আলাদা আবাসভূমি এবং যদি সম্ভব হয় তা তাদের আদি নিবাসেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে তৎকালীন তুরস্ক থেকে গ্লিসারিন এর বানিজ্য করত ইউরোপের বনিকেরা যা ইউরোপের সমরাস্ত্র যুদ্ধাস্ত্র এর চালিকাশক্তি বলে বিবেচিত হত, কিন্তু তুরস্কের গ্লিসারিন বানিজ্য বন্ধ ঘোষণা করলে নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে অটোম্যানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটিশ বাহিনী। এসময়ই ত্রাতার ভূমিকায় হাজির হয় ইহুদী বিজ্ঞানী ডঃ ‘কাইম অয়াইজম্যান’। তিনি এসিটোন আবিস্কার করে এর ফর্মুলা ব্রিটিশদের কাছে প্রকাশ করেন যা গ্লিসারিন এর পরিবর্তে সমরাস্ত্র ঠিক রাখার কাজের ব্যাবহৃত হয় এবং বিনিময়ে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইহুদীদের জন্য আলাদা আবাসভূমির দাবি করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বর্তমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন অঞ্চল অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মুসলমান শাসকদের অদূরদর্শিতা এবং ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের কারণে তুরস্কে মুসলিম খিলাফত ভেঙ্গে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ বাহিনী ১৯১৭ সালে ইরাক, সিনাই উপত্যকা,ফিলিস্তিন ও পবিত্র জেরুজালেম দখল করে নেয়। অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পর বর্তমান ইসরাইল, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন অঞ্চলগুলো ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের ম্যান্ডেটের অধীন চলে যায়। এই সময়েই জায়ানিস্ট সংঘের তৎপরতা বাড়তে থাকে এবং ইউরোপে বসবাসকারী ইহুদিদের আদিভূমি ফিলিস্তিন অঞ্চলে ফিরে যাওয়ার আন্দোলন তীব্রতর হয়। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী । ‘আর্থার জেমস’ বালফোর ইহুদীবাদীদেরকে লেখা এক পত্রে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি করেন যা বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত। ব্রিটিশদের এই ঘোষণার কারণ হিসেবে দুইটি বিষয় মানা হয়,একেতো এসিটোন এর ফর্মুলা প্রদান করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অভাবনীয় সাফল্য পায় ব্রিটিশ বাহিনী,সেই সাহায্যের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এবং সেই সাথে ব্রিটিশরা চাইনি ইহুদীদের ইউরোপে জায়গা দিয়ে জঞ্জাল সৃষ্টি করতে। কারণ তারা জানতো ইহুদীরা ঐতিহ্যগতভাবেই ক্ষমতালিপ্সু,বেঈমান জাতি যারপরনাই ইহুদীদের জন্য আলাদা রাস্ট্র প্রতিষ্ঠায় তারা আগ্রহী ছিল।ইহুদীদের আলাদা রাষ্ট্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ার পর বিপুল সংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। দুর্বল শক্তির কারণে প্রথম পর্যায় থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান রাষ্ট্র সমূহ ফিলিস্তিনে ইহুদীদের আগমনকে বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়। ইহুদীরা ফিলিস্তিন আসা শুরু করলে ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা কয়েক হাজারে উন্নীত হয়। কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০ হাজারে উন্নীত হয়। এরপর শুরু হয় বিশ্ব ইহুদীদের একত্রিত করার কাজ।আরব মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ, তাদের শক্তি খর্ব, তাদের মাঝে অনৈক্য স্থাপন ও আরবশক্তিকে দমনের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রকাশ্যে ইহুদী অভিবাসীদের ধরে এনে ফিলিস্তিনে জড়ো করার কাজ শুরু করা হয়। ফলে ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ সাল নাগাদ ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৫ হাজারে পৌঁছে যায়।ধীরে ধীরে ইসরাইল ইহুদীদের জন্য নিরপরাধ ও স্বাধীন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠার ফলে সেখানে ইহুদীর সংখ্যা দ্রুতই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৩১ সালে ইহুদীদের সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৮০ হাজারে পৌ
১৯১৮ সালে ব্রিটেনের সহযোগিতায় গঠিত ইসরাইলের গুপ্ত ইহুদী বাহিনী “হাগানাহ” ইহুদীবাদীদের অবৈধ রাষ্ট্র তৈরি র কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। প্রথম পর্যায়ে ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদীদের সহায়তা করা হাগানাহ বাহিনীর দায়িত্ব হলেও পরবর্তীকালে তারা সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত হয়। ফিলিস্তিনী জনগণের বাড়িঘর ও ক্ষেতখামার দখল করে তাদেরকে ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করা এবং বাজার ও রাস্তাঘাটসহ জনসমাবেশ স্থলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফিলিস্তিনীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ছিল হাগানাহ বাহিনীর প্রধান কাজ। মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাসকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি একটি স্বাধীন ও একচ্ছত্র মুসলমানদের এলাকা হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিতকরা সংক্রান্ত ১৮১ নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘ ইহুদীদের ক্রীড়নকেপরিণত হয়ে মার্কিন ও ব্রিটেনের চক্রান্তকে সফল করার উদ্দেশ্যে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের বিরোধিতাকেতোয়াক্কা না করে ফিলিস্তিনকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাব পাশ করে। এই প্রস্তাব অনুসারে জাতিসংঘ মাত্র ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনীদের প্রদান করে এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি ইহুদীবাদীদের হাতে ছেড়ে দেয়। এভাবে ফিলিস্তিনের ভূমিকে জোর পূর্বক দখল করে গঠন করা হয় নতুন ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল। ১৯৪৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ছোট রাষ্ট্রগুলোকে চাপদিতে থাকে জাতিসংঘে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের পক্ষে ভোট দেয়ার জন্য। মার্কিনদের প্রবল চাপ ও মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনির ম্যানডেট ছেড়ে দেয়। ওই দিনই ইহুদি নেতারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। পরদিন আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়। উপরন্তু প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্রের একটা বড় অংশ দখল করে ইসরায়েল। সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয়।
স্বাধীনতা লাভ করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সাহায্যে ইসরাইল অস্ত্র-শস্ত্র ও শক্তিতে পরাক্রমশালী হয়ে উঠে। মিত্রদের সহযোগিতা ও আশকারায় দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ইসরায়েল। ষাটের দশকে পারমাণবিক বোমার মালিক বনে যায় তারা। দখলদারি ও বর্বরতার ব্যারোমিটার বাড়তে থাকে আর সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরায়েলের একগুঁয়েমি ও নৃশংসতায় ফিলিস্তিনে রক্তগঙ্গা বইতে থাকে। যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ভূমি দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল সেই ফিলিস্তিনকে পরাধীনকরে ফিলিস্তিনের বাকি ভূমিগুলোকেও দখলের পায়তারা করতে থাকে ইসরাইল। বিনা অপরাধে, বিনা উস্কানিতে ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো শুরু করে ইসরাইল। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো মার্কিনীদের সেবা দাসে পরিণত হওয়ায় তারা ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে খুব বেশী আন্দোলন মুখর হতে ব্যর্থ হয়। ফিলিস্তিনি ভূমি জোর করে দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন করার পর থেকে ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করে চলেছে। আপনি যতক্ষণে এই লেখাটি পড়ে শেষ করবেন ততক্ষনে ফিলিস্তিনে কমপক্ষে একশ বা তার থেকেও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করছে কোন মরণাস্ত্রের আঘাতে।অসংখ্য শিশু পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই।অসংখ্য মা সন্তানহারা হচ্ছে প্রতি মুহুর্তে।সেখানে বেচে থাকাই আশ্চর্যজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরব-ইসরায়েলের মধ্যে ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে ফিলিস্তিন ইস্যুতে তিনটি যুদ্ধ হয়। এতে ফিলিস্তিনের ভাগ্যে দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই জোটেনি।
মুক্তির সংগ্রামের লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও)। ১৯৬৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ইয়াসির আরাফাত ছিলেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান।দখলদারির অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করতে ১৯৮৭ সালে গঠিত হয় হামাস। তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক শাখা রয়েছে। কট্টরপন্থী সংগঠনটি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় না।
ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকারের পক্ষে শুরুতে যে রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠেছিল-সেটি হল ফাতাহ। ইয়াসির আরাফাত ছিলেন যার নেতা।ধারণা করা ইয়াসির আরাফাত কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছে ইসরায়েল।ইয়াসিরের মৃত্যুর পর ফাতাহ ইসরায়েলি নেতাদের পুতুলে পরিণত হয়।ফাতাহ জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে সৃষ্টি হয় ‘হামাস’ যারা আপোষহীন এবং পশ্চিমা মিডিয়ার কল্যাণে যাদের আমরা জঙ্গি গোষ্ঠি হিসেবেই জানি!ফাতাহ ও হামাসের মধ্যেও রয়েছে বিরোধ।যার ফলে ফিলিস্তিনের দুই অংশ শাসন করছে এই দুটি ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন।পশ্চিম তীরে ফাতাহ এবং গাজা উপত্যকায় হামাস প্রভাব বিস্তার করেছে। এতে সমস্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ ইসরায়েলসহ অনেকগুলো দেশই হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে। ২০০৬ এর নির্বাচনে হামাস সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলেও তাদেরকে কোন আন্তর্জাতিক সমঝোতা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেয়া হয়নি।
পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠি তথা মিডিয়া যেটাকে ‘আরব অঞ্চলের গন্ডগোল’ বলে থাকেন সেটি মূলত ইসরায়েলের ক্রমাগত আক্রমন এবং তার বিপরীতে হামাসের প্রতিঘাত।মুক্তিযুদ্ধ কে যেমন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ‘গন্ডগোল’ বলে বিশ্বের কাছে প্রচার করত এখানেও ব্যাপারটি তেমন।হামাস মূলত সেদেশের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা যারা এই উপনিবিশের বিরূদ্ধে সংগ্রাম করে চলছে।
বর্তমানে ফিলিস্তিনে যে ইসরায়েল আগ্রাসন চলছে সেটা নতুন নয়।ইতিহাসে অসংখ্যবার তারা রক্ত বন্যা বইয়ে দিয়েছে ফিলিস্তিনের জনপদ গুলোতে।কারণ এটাই তাদের পরিকল্পনা।ঘুমিয়ে থাকা মানুষ কে মুহুর্তে হত্যা করে ফেলা,তাদের বসত বাড়ি ভূখন্ড দখল নিয়ে ইহুদিদের জন্য নতুন আবাস সৃষ্টি করা।হত্যার পর তারা সমস্ত বাড়িঘর গুড়িয়ে দেয় এবং সেখানে দ্রুত বর্ধনশীল ইউক্যালিপটাস গাছ লাগিয়ে দেয় যেন বেচে যাওয়া ফিলিস্তিনিরা ফিরে এলেও নিজেদের ভীটে মাটি সনাক্ত করতে না পারে!
গত কয়েক বছরের ইসরাইলি বর্বর হামলায় ফিলিস্তিনিদের আকাশে যে নির্মম ইতিহাস রচনা হয় বিশ্ববাসী এর আগে এমন ভয়াবহ গনহত্যা দেখে নাই। জাতিসংঘ থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ইসরাইলী সেনাদের হামলায় গত ৭ বছরে ৬ হাজার ৫০০ ফিলিস্তিনী মারা গিয়েছেন। এদের মধ্যে ৯৫০ জন হচ্ছে ফিলিস্তিনী শিশু ও কিশোর। একই সময়ে ইহুদীবাদীদের বর্বরোচিত হামলায় আহত হয়েছেন ৫৫ হাজারেরও বেশী ফিলিস্তিনী। এছাড়া গত সাত বছরে ইসরাইলী সেনারা প্রায় ৬০ হাজার ফিলিস্তিনীকে বন্দী করেছে। এদের মধ্যে ৬ হাজার ৫০০ জন শিশু এবং ৭০০ জন নারী। ফিলিস্তিনী এলাকাগুলো থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া ৬০ হাজার ফিলিস্তিনীর মধ্যে এখনো প্রায় ১১ হাজার জন ইসরাইলী বন্দী শিবিরগুলোতে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। এখনো ইসরাইলী কারাগারে আটক ফিলিস্তিনী বন্দীর মধ্যে ১১০ জন নারী এবং ৪০০ জন শিশু।
বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইসরাইলী কারাগারগুলোতে গত ২০ বছরেরও বেশী সময় ধরে বন্দী ফিলিস্তিনীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার ৫০০ জন। এদের সাথে গত ৭ বছরে গ্রেফতারকৃত ফিলিস্তিনীর সংখ্যা যোগ করলে ইহুদীবাদী বন্দী শিবিরগুলোতে চরম দুর্ভোগের মধ্যে থাকা ফিলিস্তিনী বন্দীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১২ হাজার ৫০০ জন। ইসরাইলী কারাগারগুলোতে ফিলিস্তিনী বন্দীদের সাথে চরম অমানবিক আচরণ ও নির্দয় অত্যাচার করা হয়। গত প্রায় ৪ দশকে ইসরাইলী কারাগারগুলোতে ১৯৭ জন বন্দী ইহুদীবাদীদের অকথ্য নির্যাতনের কারণে শহীদ হয়েছেন। এছাড়া এসব নির্যাতনের শিকার শত শত ফিলিস্তিনী পঙ্গু হয়ে গেছেন এবং অনেকে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন। গত ৪ দশকে প্রায় ৮ লাখ ফিলিস্তিনীকে ইসরাইলী সেনারা ধরে নিয়ে তাদের বন্দী শিবিরগুলোতে নিপে করেছে। ফলে এসব ফিলিস্তিনীকে তাদের জীবনের একটি সময়কে ইহুদীবাদী নির্যাতন ক্যাম্পে অতিবাহিত করার দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
ইসরাইলী কারাগারগুলোতে বন্দীদের ওপর অকথ্য নির্যাতনের বিষয়টি যাতে ফাঁস না হয়, সেজন্য বিগত বহু বছর ধরে অধিকাংশ ফিলিস্তিনী বন্দীর সাথে তাদের পরিবারের সদস্যদের দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না। এছাড়া আন্তর্জাতিক রেডক্রস এক বিবৃতিতে বলেছে, তেলআবিব ইসরাইলী বন্দীশিবিরগুলোর পরিস্থিতি পর্যবেণ করার জন্য ঐ সংস্থার কর্মীদের ইসরাইল সফরের অনুমতি দিচ্ছে না।ইসরায়েল সরকার যে ফিলিস্তিনীদের ধরে এনে কারাগারে নিপে করছে তাই নয়, সেই সাথে প্রায় সব সময়ই ফিলিস্তিনী এলাকাগুলো অবরোধ করে সেখানকার বাসিন্দাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। তাদেরকে খাদ্য, পানীয় ও চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখছে। ফলে অধিকৃত এলাকাগুলো ফিলিস্তিনীদের জন্য একটি বৃহৎ বন্দীশালায় পরিণত হয়েছে। গাজা উপত্যকায় গত কয়েক মাসের ইসরাইলী অবরোধের কারণে বিনা চিকিৎসায় ১৪৫ জন ফিলিস্তিনীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার বিশেষজ্ঞরা গাজার বর্তমান দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে ঐ উপত্যকাকে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ জেলখানা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনী শরণার্থী বিষয়ক জরুরী সাহায্য প্রদানকারী সংস্থার পরিচালক জন জিং এ সম্পর্কে বলেছে, ইসরাইলী অবরোধের কারণে গাজা এখনো একটি বৃহৎ জেলখানা হয়ে রয়েছে এবং এখানকার অধিবাসীরা অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
ইসরাইলী সেনারা গত এক দশকে ফিলিস্তিনীদের দশ হাজারেরও বেশী বাড়িঘর ধ্বংস করেছে। এ সময়ে তারা ফিলিস্তিনীদের হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট করেছে। ইহুদীবাদীদের এই ভয়াবহ অমানবিক কর্মকান্ডের ব্যাপারে আরব দেশগুলো সম্পূর্ণ নীরব রয়েছে বলা চলে। এমনকি কয়েকটি আরব দেশ ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে। আরবদের এই ঘৃন্য আচরণের কারণে ইহুদীবাদী সরকার আরো বেশী ধৃষ্ঠতার সাথে ফিলিস্তিনীদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালাচ্ছে। ফিলিস্তিনের আরব জনগোষ্ঠির ওপর ইসরাইলীদের অমানবিক আচরণের ব্যাপারে পশ্চিমাদের পদলেহী আরব সরকারগুলোর নীরবতার ব্যাপারে এসব দেশের জনগণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ১৯৫১ সালে আরব লীগ ইসরাইলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে একটি দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছিল। কথা ছিল সকল আরব দেশ এই দপ্তরের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা বজায় রেখে ইসরাইলের সাথে সব ধরনের সম্পর্ক এড়িয়ে চলবে। কিন্তু বর্তমানে বহু আরব দেশ ঐ দপ্তরকে সহযোগিতা না করে বরং তেলআবিব ও তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক মার্কিন সরকারের সাথে দহরম মহরম চালিয়ে যাচ্ছে।এমতাবস্থায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী জনগনের মাঝে ভাগ, বিদ্বেষ এবং রাজনৈতিক ভাবে অদূরদর্শিতা সেই সাথে আন্তর্জাতিক মহলের নীরব অবস্থান ফিলিস্তিন সংকট কে দিনে দিনে আরও বেশী পরিমানে অন্ধকারে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।বারবার ইসরায়েল ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনা শুরু হলেও তা কখনোই আলোর মুখ দেখেনা যার ফলাফল হওয়া উচিৎ ছিল যে ইসরায়েল কর্তৃক দখলকৃত ভূমি ফিলিস্তিনিদের ফেরত দেয়া এবং সেই সাথে ফিলিস্তিনকে আলাদা স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা ।এখন চেয়ে থাকা আন্তর্জাতিক জোটগুলোর অবস্থানের উপর,তাদের চিন্তার উপর,এত এত রক্তস্রোত এ বিধৌত জনপদ কি রক্তের বিনিময়ে তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা ফিরে পাবে ???