শিরোমণি ডেস্ক : দেশের করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। মার্চের শুরু থেকে ধাপে ধাপে সংক্রমণ বাড়ছে। গত পাঁচ দিন ধরে সংক্রমণ সাড়ে তিন হাজারের বেশি। বাড়ছে মৃত্যুও। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত সাড়ে তিন মাসের মধ্যে এক দিনে এটিই সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা কিছুদিন ধরেই কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের কারণে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছিল না। ১০ দিনব্যাপী ওই অনুষ্ঠান গতকাল শুক্রবার শেষ হয়েছে। এখন সরকার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে আবার নড়েচড়ে বসেছে।
এরই অংশ হিসেবে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে একটি প্রস্তাব তৈরি করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে আপাতত লকডাউন কিংবা সাধারণ ছুটি ঘোষণার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভাবা হচ্ছে। এপ্রিল মাসের শুরুতেই এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হতে পারে বলে সরকারের একটি সূত্র সমকালকে জানিয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। সরকার এখন করোনা নিয়ন্ত্রণে জোর দেবে। বেশকিছু কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে।
কবে নাগাদ বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করা হবে- এ প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এক থেকে দু’দিনের মধ্যে একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। সেখানে যাচাই-বাছাই শেষে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর মাঠ পর্যায়ে তা কার্যকর করা হবে। আগের মতো সরকারের সংশ্নিষ্ট সব মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ এ বিষয়ে একযোগে কাজ করবে।
স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, করোনা সংক্রমণের জন্য গণজমায়েত ও মাস্ক ব্যবহার না করা সবচেয়ে বেশি দায়ী। এই দুটি বিষয়কে সামনে রেখে করোনা নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, গণজমায়েত, বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্রে মানুষের ভিড় হয়। এটিই করোনা সংক্রমণের বড় কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এসব অনুষ্ঠান আয়োজনে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে নতুন প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। সারাদেশে এই বিধিনিষেধ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসন এসব বিষয় সার্বক্ষণিক মনিটর করবে। একই সঙ্গে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত জোরালোভাবে মাঠে নামবে। মাস্ক না পরলে দণ্ড ও জরিমানার বিধান রাখা হচ্ছে।
টিকা নেওয়ার পরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালকসহ অন্তত অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মার্চের শুরুর দিকে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কয়েকজন সপরিবারে কক্সবাজার, সেন্টমার্টিনসহ দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে ভ্রমণ করেন। সেখান থেকে ফেরার তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে তারা সপরিবারে আক্রান্ত হয়েছেন। ওই ব্যক্তিরা মহাপরিচালকসহ অন্যদের সংস্পর্শে যাওয়ায় তারাও আক্রান্ত হয়েছেন। এর পরই স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ট্যুরিজম বোর্ডের কাছে হিসাব চাওয়া হয়, কতসংখ্যক মানুষ মার্চের শুরু থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত কক্সবাজার ভ্রমণ করেছেন। এতে দেখা যায়, ২০ দিনে কেবল কক্সবাজারেই ২৫ লাখ মানুষ ভ্রমণ করেছেন। এর পরই ট্যুরিজম এলাকাগুলোকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য বিভাগ। কঠোর বিধিনিষেধের আওতায় পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে এক নম্বরে রাখা হচ্ছে।
তাগিদ বিশেষজ্ঞদের :বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, সংক্রমণ মোকাবিলায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ এবং তা কার্যকর করা প্রয়োজন। কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন মহলে বিষয়টি বলে আসছি। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক ব্যবহার এবং সামাজিক দূরত্ব কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ, মানুষকে ঘরে রাখার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া কেউ যাতে ঘরের বাইরে না যায়, সেজন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। কারণ বাংলাদেশে লকডাউন কার্যকর করা সম্ভব হবে না। লকডাউন কিংবা সাধারণ ছুটি নিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা ভালো নয়। সরকার ছুটি ঘোষণার পর মানুষ দলবেঁধে গ্রামে চলে গেছে। এতে করে সংক্রমণ আরও বেড়ে যায়। সুতরাং সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এর বিকল্প নেই।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া ভাইরাস বাংলাদেশেও এসেছে। কয়েকজন শনাক্ত হয়েছে। যুক্তরাজ্য থেকে আরও মানুষ আসছে। ওই নতুন ধরনটি মারাত্মক এবং এটি সংক্রমণ ছড়ালে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। সুতরাং সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
দেশের চিত্র :এ পর্যন্ত দেশে করোনায় আট হাজার ৮৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সঙ্গে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও তিন হাজার ৬৭৪ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৯১ হাজার ৮০৬ জনে পৌঁছাল। এর বিপরীতে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনার সংক্রমিত এক হাজার ৯৭১ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। করোনা সংক্রমিত মোট পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার ৯২২ জন সুস্থ হয়ে উঠলেন। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৯০ শতাংশ।