মোশারফ হোসেন লিটন সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ঃ বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)’র নিয়ন্ত্রণাধীন দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সিমেন্ট কারখানা ছাতক সিমেন্ট কোম্পানির নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও স্থায়িত্ব নিয়ে শংকা দেখা দিয়েছে। ছাতক সিমেন্ট কারখানা আধুনিকায়নে ব্যালেন্সিং মর্ডানাইজেশন রেনোভেশন এন্ড এক্সপেনশন (বিএমআরই) প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হরিলুটের পায়তারায় লিপ্ত একটি মহল। বিভিন্ন অভিযোগ ও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের প্রেক্ষিতে বিসিআইসির উচ্চ পর্যায় থেকে কয়েকটি তদন্ত চলমান রয়েছে। কিন্তু হরিলুটে জড়িত সিন্ডিকেটকারীদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। জানা যায়, এই কারখানায় উৎপাদিত ডায়মন্ড ব্র্যান্ডের সিমেন্টের চাহিদা ও খ্যাতি রয়েছে দেশের বাইরেও। অতীতে কারখানাটি আধুনিকায়নের উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো কারখানাটি বেসরকারিকরণের অপচেষ্টা চালানো হয়। পরবর্তীতে শিল্প মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক এমপির প্রচেষ্টায় ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ওয়েট প্রসেস থেকে কারখানাটিকে ড্রাই প্রসেস প্রকল্পে রূপান্তর করতে ২০১৬ সালের ৮ মার্চ একনেকে আধুনিকায়ন ড্রাই প্রসেস প্রকল্পের অনুমোদন হয়। আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে কার্যাদেশ পেয়ে চীনের নানজিং সি-হোপ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ৮৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন প্রকল্পের কাজে হাত দেয়। কাজ শুরুর পর থেকে প্রকল্পে ব্যাপক দূর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ উঠে। দূর্নীতি দমন কমিশনের মহা-পরিচালক বরাবর ছাতকের আব্দুর রশীদ নামের এক ব্যাক্তির দেয়া অভিযোগ থেকে জানা যায়, নানজিং সি- হোপ মূলকাজটি পেলেও এর মূল নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন বিসিআইসির বেশ ক’জন কর্মকর্তা ও নানজিং সি- হোপ’র কান্ট্রি ডিরেক্টর। পূর্বে ঘোড়শাল সার কারখানায় কন্ট্রোল বাল্ব ক্রয়ের জন্য একটি আন্তর্জাতিক টেন্ডারে অংশগ্রহণ করেন নানজিং সি-হোপ এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. নাজির মোঃ খান। টেন্ডারে তিনি সর্বনিম্ন দরদাতা হিসাবে ক্রয়াদেশ পান। বাল্ব সাপ্লাইয়ের কয়েকদিন পরেই এগুলো সিজ হয়ে যায় এবং কারখানার উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটে। ওই সময় তার ফার্ম এম এম সার্ভিসকে কালো তালিকাভুক্ত করে বিসিআইসি। তাদের দূর্নীতির কারণে চট্রগ্রাম কেমিক্যাল কমপ্লেক্সেটি আজ বন্ধ রয়েছে। ছাতক সিমেন্ট কারখানার বিএমআরই প্রকল্পের আওতায় এক্সেভেটর, এয়ার কম্প্রেশার, ড্রাম ট্রাক, ফ্রক লিফটার, লকোমেটিভ ইঞ্জিন, হুইল লোডার ক্রয়ের তিনটি আন্তর্জাতিক টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে সেই ডঃ নাজির মোঃ খানের আরো দুইটি প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল মেশিনারিজ ও সেকনিক বাংলাদেশ। তিনটি টেন্ডারেই তার প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হয়। নিম্নমানের মেশিনারিজ সরবরাহ করার অভিযোগ রয়েছে তার এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। তিনটি টেন্ডারের সাথে ১ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কথা থাকলেও এগুলো না করেই বিল নিয়ে চলে যায় তার প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ছাতক সিমেন্ট কারখানার নতুন প্রকল্প তদারকি করার জন্য ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশি কন্সালটেন্ট (পরামর্শক) নিয়োগ করা হয়। পরামর্শকরা প্রকল্প পরিদর্শন না করেই নিয়মিত বিল তুলে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। । ছাতক সিমেন্ট কারখানার বিএমআরই প্রকল্পের জন্য ইউরোপীয়ান, আমেরিকান ও জাপানিজ স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করার কথা থাকলেও প্রকল্পের পরিচালক ও কারখানার ব্যাবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এফ এম বারী ও বিসিআইসির পরিচালক লুৎফুর রহমান সহ ক’জনকে ম্যানেজ করে কারখানার জন্য সরবরাহকৃত নিম্নমানের চায়নিজ মালামাল গ্রহণ করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যেই একটি কিলনের মূল্য নেয়া হয়েছে ৭০কোটি টাকা। প্রকৃতপক্ষে চায়নিজ এ কিলনটির মূল্য ২০ কোটি টাকা বলে ছাতক সিমেন্ট কারখানার সাবেক এক এমডি জানিয়েছেন। এদিকে কার্যাদেশ অনুযায়ী ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভার্টিক্যাল বয়লার আনার কথা থাকলেও মাত্র ৬কোটি টাকা মূল্যের কোনো ধরনের ড্রয়িং এপ্রুভাল ছাড়াই একটি হরিজেন্টাল বয়লার কারখানায় নিয়ে আসা হয়েছে। বিসিআইসির নির্দেশনা অনুযায়ী প্রজেক্টের সকল কাজ দুবাই থেকে আমদানি করা উন্নত মানের পাথর দিয়ে সম্পন্ন করার কথা থাকলেও অনেকাংশে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্রাশিং চুনাপাথর। যা এত ভারি কন্সট্রাকশন কাজের জন্য মোটেই উপযোগী নয় বলে একাধিক প্রকৌশলীরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন । অভিযোগ ওঠেছে, ইতিমধ্যেই সাড়ে দশ হাজার টন পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ২৬শত টন দুবাই থেকে আমদানি করা। বাকিগুলো হচ্ছে এখানের ক্রাশিং চুনা পাথর। অভিজ্ঞ মহলের অভিমত, ক্রাশিং চুনাপাথর দিয়ে গুরুত্বপূর্ন স্থাপনার কাজ করা হলে প্লান্টের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে যেকোনো সময় চুনাপাথর গলে কোম্পানির বড় ধরনের ক্ষতির আশংকা থেকে যায়। এদিকে ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ডায়মন্ড ব্র্যান্ডের সিমেন্ট কারখানাটি চালু রেখেই নতুন প্রকল্প নির্মিত হওয়ার কথা থাকলেও চুনাপাথর সংকটের কারণ দেখিয়ে কারখানাটি বন্ধ রাখা হয়েছে। অন্যদিকে এই কারখানাটিকেই পুজি করে একটি মহল প্রকল্পের টাকা লুটপাটে মেতে উঠেছে।কারখানার বিভিন্ন অংশ কেটে ও ভেঙ্গে দেয়ার অজুহাতে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। লক্ষ লক্ষ টাকার যন্ত্রাংশ ও স্ক্রাপ মাল চোরাই পথে বিক্রি করা হচ্ছে। এ চক্রের সাথে স্থানীয় ও কারখানার কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছে বলে এলাকার বেশ ক’জন লোক জানিয়েছেন। কারখানার এমন অবস্থা এখন যে যেভাবেই পারে লুঠেপুঠে খাচ্ছে। এ যেন এক লুটপাটের মহোৎসব চলছে । ছাতক সিমেন্ট কারখানার সিবিএ সেক্রেটারি আব্দুল কুদ্দুছ বলেন, স্থানীয়ভাবে কোনো মনিটরিং কমিটি না থাকায় কন্ট্রাকটর ইচ্ছেমতো কাজ করছে। এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক ও কারখানার এমডি প্রকৌশলী এফ এম বারী জানান, কিছু অনিয়মের কথা শুনেছেন তিনি।তবে এসব বিষয়ে তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। ক্রাশিং চুনাপাথর ব্যবহারের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান। কান্ট্রি ডিরেক্টর ডঃ নাজির মোঃ খানের সাথে ফোনে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করে কথা বলা সম্ভব হয়নি।##
১ view