রেদোয়ান হাসান সাভার,ঢাকা প্রতিনিধি দৈনিক শিরোমণিঃ
করোনা সংক্রমণের কারণে প্রায় দুই বছর বন্ধ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আবাসিক হল ও দোকানপাট বন্ধ থাকায় মুখর ক্যাম্পাস একেবারেই নিস্তব্ধ। আবাসিক বাসিন্দারা ছাড়া ক্যাম্পাসে দেখা মেলে না কারোই। এতে সবচেয়ে বিপদে পড়েছে ক্যাম্পাসে ঘুরেফেরা কুকুর ও বিড়াল গুলো। আবাসিক হল গুলোর শিক্ষার্থীদের খাবারের উচ্ছিষ্ট খেয়েই জীবন বাঁচতো এই অবলা জন্তু গুলোর। আবার অনেক শিক্ষার্থীই নিজেদের খাবার ভাগাভাগি করতেন এদের সাথে। পাশাপাশি খাবারের দোকান গুলো বন্ধ থাকায় খাবারের উৎস পুরোপুরি বন্ধ। বেশিরভাগ সময় কুকুর-বিড়াল গুলোকে দেখা যায় বিভিন্ন অনুষদের সামনে দেখা যায় নিথর পড়ে থাকতে। শুধু কুকুর-বিড়াল গুলো যে চরম খাদ্য সংকটে আছে এমন না। ক্ষুধার জ্বালায় প্রায় বনজঙ্গল থেকে লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে শিয়াল। গুইসাপ, বেজিসহ বিভিন্ন সরিসৃপ জাতীয় প্রাণি গুলোরও দেখা মিলছে সড়কে। তবে এই অভুক্ত প্রাণিদের পাশে অনেকটা দেবদূত হয়ে দাড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী আজম। শহীদ সালাম-বরকত হলের প্রভোস্টও তিনি। ক্যাম্পাসে বিচরণ করা এসব ক্ষুধার্থ প্রাণীদের হাহাকার চোখে পড়ে শিক্ষক আজমের। প্রতিদিন রুটিন করে নিজের বাসায় কুকুরদের জন্য খাবার রান্না শুরু করেন। পরে গভীর রাত পর্যন্ত সেই খাবার পৌছে দেন ক্যাম্পাসের প্রায় চার কিলোমিটার জুড়ে বিচরণ করা কুকুর গুলোর কাছে। কুকুরদের খাবার দিতে গিয়ে শিক্ষক আজমের নজরে অভুক্ত শিয়ালদের বিষয়টিও। কুকুরদের দেয়া খাবারের ঘ্রাণে দিক-বিদিক ছুটোছুটি করতে থাকে শিয়াল গুলো। এরপর থেকে শিক্ষক আজম শিয়ালদের জন্যও বাড়তি খাবারের ব্যবস্থা করেন। কুকুরের সাথে শেয়ালদেরও সড়কে বিতরণ করেন খাবার। এখন এই কুকুর-শিয়াল গুলো রাতের বেলা খাবার নিয়ে আসা গাড়ি দেখলেই ছুটে আসে। কুকুর-শিয়াল গুলো জড়ো হয় শিক্ষক আজমের আশপাশে। পরক্ষণেই পরম মমতায় খাবার পরিবেশন করেন এদের। এখন আলী আজমের কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক শিক্ষক ও কর্মচারীরাও অভুক্ত প্রাণিদের খাবার সহায়তা করছেন। পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকের বাড়ির সামনেও খাবারের জন্য জড়ো জয় বিড়াল ও গুইসাপ। প্রতিদিন বাজার থেকে পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া মাছ কিনে এনে এদের পরিবেশন করেন এই শিক্ষক। এছাড়া বিভিন্ন আবাসিক হলের নিরাপত্তাকর্মীরাও তাদের খাবারের কিছুটা অংশ এসব অবলা প্রাণিদের দিয়ে থাকেন।অধ্যাপক ড. আলী আজম বলেন, ‘জাপানে আমি দীর্ঘ ১৪ বছর থেকেছি। সেখান থেকেই আমার ভেতর চেঞ্জটা আসে। জাপানে যেটা দেখেছি, তারা প্রত্যেকটা জীবজন্তুকে ভিতর থেকে দেখে। সেই ধারণা থেকে আমি প্রাণিদের জন্য অতীতেও কিছু করেছি। আর এই করোনাকালীন সময়ে যখন ২০২০ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। আমি যে হলের প্রভোস্ট তখন ওইখানে বেশ কিছু কুকুর নরমালি আসতো। তাদের চোখের দিকে যখন আমি তাকাইলাম। তখন মনে হলো তারা খুব ক্ষুধার্থ। ওই দিন থেকেই স্থির করেছিলাম যতটুকু পারি আমার সাধ্যমত তাদের কিছু রান্না করে খাওয়াবো। এখান থেকেই শুরু। সেই থেকে আস্তে আস্তে কুকুর, বিড়াল ও শিয়ালের সংখ্যা বেড়ে গেছে।’তিনি আরও বলেন, ‘আমি যেহেতু একা মানুষ আমার পক্ষেতো সব কাভার করা সম্ভব না। তাই আমি সাড়ে চার কিলোমিটার মিলে একটা জোন করেছি। এই এলাকায় যত জীবজন্তু আছে ওই সময় থেকেই প্রত্যেক দিন রাতে আমি খাবার দিয়ে যাচ্ছি।কুকুরদের খাবার তৈরির কাজে নিয়োজিত শহীদ সালাম-বরকত হলের বাবুর্চী আব্দুর রহমান বলেন, হল বন্ধ হওয়ার কারণে আমাদের রান্নার কাজ নেই। তবে স্যারের বাসায় শিয়াল-কুকুরদের জন্য খাবার রান্না করি। প্রতিদিন মুরগির গিলা, কলিজা, পাখনা, পা এসব বাজার থেকে কিনে আনি। পরে সে গুলো তরকারির মতো করে রান্না করা হয়। এরপর গরম ভাতের মধ্যে এই তরকারি মিশিয়ে এক ধরণের খাবার তৈরি শেষে ঠান্ডা করা হয়। পরে রাতে ড্রাইভারদের নিয়ে স্যার নিজে শেয়াল-কুকুরদের খাওয়ায় আসেন।মীর মশাররফ হোসেন হলের নিরাপত্তাকর্মী জাকির হোসেন বলেন, ‘আমাদের হলে অনেক গুলা বিড়াল ও কুকুর থাকতো। করোনার সময় হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কুকুর-বিড়াল গুলা খাবারের অভাবে ছুটোছুটি করে। তখন আমাদের হলের প্রভোস্ট স্যার নিজে বিড়াল ও গুইসাপকে তার বাড়ির সামনে খাওয়ান। আমাদেরও আনা খাবার মাঝেমধ্যে ওদের দেই।পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমান বলেন, বিড়াল গুলো আমার বাসার সামনে জড়ো হয়ে ক্ষুধার জ্বালায় কাতরাতে থাকে। একটা গুইসাপও রাস্তায় ওঠে নিথর শুয়ে থাকে। তখন বিষয়টা আমার নজরে আসে। এরপর থেকেই ওদের জন্য বাজার থেকে পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া মাছ কিনে আনি আনি। তারপর ওদের খাওয়াই।’
৪ views