জেমস আব্দুর রহিম রানা যশোর প্রতিনিধি দৈনিক শিরোমণিঃ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নিরবতার সুযোগে যশোরে লাইসেন্স-ফার্মাসিস্ট ছাড়াই চলছে রমরমা ঔষধের ব্যবসা। অভিজ্ঞ ফার্মাসিস্ট না থাকায় এসব ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনে একদিকে ক্রেতারা হচ্ছেন প্রতারিত অন্যদিকে সরকার হচ্ছে রাজস্ব বঞ্চিত। তাছাড়া অনভিজ্ঞ ফার্মাসিস্টদের দেয়া ভুল ঔষধ সেবনের কারণে রোগিদের জীবন সংকটাপন্ন হচ্ছে বলে জানা গেছে।সূত্র মতে, ঔষধ প্রশানাসন অধিদপ্তর যশোরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে যশোরে নিবন্ধিত ফার্মেসির সংখ্যা ৪ হাজার ২শ ৪৮টি আর ডিপো আছে ৭০টি। যদিও নিবন্ধন ছাড়া চলছে আরো দেড় হাজারের মত ছোট বড় ফার্মেসি। তবে, নিবন্ধন ছাড়া কতগুলো ফার্মেসি আছে, তার সঠিক হিসাব দিতে পারেননি ঔষধ প্রশানাসন অধিদপ্তর । এর মধ্যে নিবন্ধিত ফার্মেসির বেশির ভাগই হয়ে গেছে মেয়াদউত্তীর্ণ। এদিকে জেলার নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ফার্মেসির অর্ধেকের বেশি ফার্মেসিতে নেই নিবন্ধিত ফামাসিস্ট। আর যার কারনে গত ১ বছরে ৫২টি প্রতিষ্ঠানের নামে মামলা করেছে ড্রাগ কোর্ট, মোবাইল কোর্ট ও ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট।এর মধ্যে কোন রকম নিবন্ধন ছাড়াই ফার্মেসি পরিচালনা করার জন্য মামলা হয়েছে খান ফার্মেসি, মর্জিনা ফার্মেসি, শিমুল ফার্মেসি, ভাই ভাই ফার্মেসি, ইমন ফার্মেসি, নিউ বিচিত্রা ফার্মেসি, মা ফার্মেসি, মাতৃ ফার্মেসি, জামরুল তলা বাজারের শিমুল ফার্মেসি ও সেনিয়া ফার্মেসির নামে।এদিকে যশোরর ৪টি ফার্মেসি নিজেদের মডেল ফার্মেসি দাবি করলেও ঔষধ প্রশানাসন অধিদপ্তর বলছে এর সংখ্যা ২টি। কমলা ফার্মেসি, রিয়াজ ফার্মা, প্যারামাউন্ট ও ইবনেসিনা ফার্মেসি নিজেদের মডেল দাবি করলেও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলছেন মডেল ফার্মেসি হল ইবনেসিনা ফার্মেসি ও প্যারামাউন্ট। বাকি দুটি মডেল ফার্মেসি শর্ত পুরন করতে পারিনি। তাদের এখনও ফার্মাসিস্টও নাই ঠিকমত, আর বাইরের ধুলাবালি মুক্ত ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিতও নয়।যশোর শহরের দড়াটানা এলাকার সদর হাসপাতাল এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব এলাকায় অনেকগুলো হাসপাতাল থাকায় প্রচুর ফার্মেসি গড়ে উঠেছে। এগুলোর ওষুধ সংরক্ষণ ব্যবস্থাসহ সার্বিক অবস্থা মানসম্পন্ন নয়। একই সাথে ফার্মাসিস্ট না থাকায় প্রতিনিয়তই ভুল ঔষুধ সরবরাহ করে ক্রেতাদের ফেলছেন বিপদে। অনেক সময় ভুল ঔষধ খেয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুকিতে পড়ছেন রোগিরা।জানা গেছে, একটি খুচরা বা পাইকারি দোকানের ড্রাগ লাইসেন্স নেওয়ার পর প্রতি দুই বছর অন্তর নবায়নের বাধ্যবাধকতা আছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নবায়ন না হলে বিলম্ব ফি দিয়ে নবায়নের সুযোগ আছে। কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও লাইসেন্স নবায়ন করছেন না অনেক ব্যবসায়ী। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকলেও মেয়াদোত্তীর্ণ এসব লাইসেন্স বাতিলে কোনো উদ্যোগই নেয় না ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। তারা বলছেন আমরা তালিকা করে ডিজির কাছে পাঠিয়েছি, তারা ব্যবস্থা নিবে।সূত্র জানিয়েছে, খুচরা ওষুধ বিক্রির জন্য দুই ক্যাটাগরির লাইসেন্স দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর মডেল ফার্মেসি ও মেডিসিন শপ। ড্রাগ লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক থেকে তিন মাসের মধ্যে ২০০ টাকা ফি দিয়ে পাইকারি, ১০০ টাকা দিয়ে খুচরা দোকানের লাইসেন্স নবায়ন করা যায়। মেয়াদোত্তীর্ণের পর তিন থেকে বারো মাস পর্যন্ত পাইকারি ব্যবসায়ীরা ৫০০, খুচরা ব্যবসায়ীরা ২০০ টাকা ফি দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করতে পারেন। মেয়াদোত্তীর্ণের ১২ মাসের ঊর্ধ্বে বা পরবর্তী বছরের জন্য পাইকারি দোকান ১ হাজার ও খুচরা দোকানের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা ফি দিয়ে লাইসেন্স নবায়নের সুযোগ আছে। এত সুযোগের পরও সারা দেশে প্রায় দেড় লাখ ওষুধের দোকানের লাইসেন্স নেই। এদের অনেকে একেবারেই নিবন্ধন নেয়নি। কেউ কেউ নিবন্ধন নিলেও পরে আর নবায়ন করেননি।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির এক সদস্য জানান, যশোরে প্রায় দেড় হাজার ফার্মেসি চলছে লাইসেন্স ছাড়া। এর মধ্যে প্রায় ১ হাজার দোকান আছে, যেগুলো খুবই নিম্নমানের। করোনা মহামারিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ওষুধের দোকান। স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জামসহ বিভিন্ন ওষুধের চাহিদা বাড়ায় এসব দোকানের ব্যবসাও জমজমাট। করোনার কারণে তদারকি কম থাকায় নকল, মানহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জাম বিক্রি হচ্ছে এসব দোকানে। তবে এসব ফার্মেসিতে ওষুধ মজুদ, প্রদর্শন ও বিক্রয় ১৯৪৬ সালের ড্রাগস রুলস অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।ঔষধ প্রশানাসন অধিদপ্তর যশোরের সহকারী পরিচালক নাজমুল হাসান আমাদের প্রতিবেদক জেমস আব্দুর রহিম রানাকে জানান, ফার্মেসি চালু করার জন্য বাধ্যতামূলক হচ্ছে, ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে ড্রাগ লাইসেন্স নেওয়া এবং প্রত্যেক ফার্মেসিতে একজন সনদপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট থাকা। অথচ বেশিরভাগ ফার্মেসিতেই নেই ড্রাগ লাইসেন্স আর সনদপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট। এদের অনেকের বিরুদ্ধে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন রোগের স্পর্শকাতর ওষুধ বিক্রিরও অভিযোগ আছে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের নির্দেশে দেশের সব জেলার ড্রাগ সুপার, সিভিল সার্জন, উপজেলায় কর্মরত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের নিজ নিজ এলাকার ওষুধের দোকানের তথ্য জানাতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কতটি ফার্মেসি আছে, কতগুলোর লাইসেন্স আছে আর কতগুলোর লাইসেন্স নেই ইত্যাদি তথ্য জানাতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘দেশের সব ওষুধের দোকানে তদারকি বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেসব ফার্মেসির লাইসেন্স হালনাগাদ নেই, তাদের রিনিউ করার সময় দেওয়া হবে। আর যাদের লাইসেন্স নেই, কিন্তু দোকানের মান ভালো, তাদের লাইসেন্সের আওতায় আনা হবে। যাদের অবস্থা একেবারেই খারাপ, সেসব ফার্মেসি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাবেক পরিচালক জাকির হোসেন রনি বলেন, ‘সারা দেশে লাইসেন্সধারী ফার্মেসি আছে প্রায় দেড় লাখ। আর লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসি আছে আরও প্রায় দেড় লাখ। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির দুর্বলতার কারণে লাইসেন্স ছাড়া এবং মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছে অনেক ফার্মেসি। এসব ফার্মেসির যেগুলো একেবারেই মানসম্পন্ন নয়, সেগুলো বন্ধ করতে হবে। তবে মানসম্পন্ন ফার্মেসিগুলোকে শর্ত শিথিল করে হলেও দ্রুত লাইসেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে।এ ব্যাপারে ডাক্তার ইউসুফ আলী বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই যে কেউ যেকোনো ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে পারে। এসব বেশি বিক্রি করে লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসিগুলো। প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর ওষুধ সেবনের ফলে রোগীদের মধ্যে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে।‘ মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান না চালিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে নিয়মিত অভিযান চালানোর পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।