মো. রুবেল আহমেদ (বিশেষ প্রতিনিধি, টাঙ্গাইল)
মানুষের জীবন যাত্রায় এসেছে আমুল পরিবর্তন, এখন আর কেউ সূর্য দেখে সময় নির্ধারণ করে না, এখন কূপের পানি কেউ পান করেনা, মাটির হাড়িতে রান্না কেউ করে না, যোগাযোগ রক্ষা করতে চিঠি আদান-প্রদানের উপর নির্ভর করতে হয় না।
সবকিছুতে লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া ও প্রযুক্তির ছোঁয়া। যা প্রতিটি মানুষের লাইফস্টাইলকে স্বপ্নের মতো বদলে দিয়েছে । কিন্তু বিগত চল্লিশ বছরেও কোনো পরিবর্তন আসেনি সুফিয়া বেগমের জীবনে, চল্লিশ বছর ধরে ঘানিতে আটকে আছে তার জীবন ।
টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার জোত আতাউল্লাহ ব্যাপারি বাড়িতে তার বসবাস,
বয়স আনুমানিক পঞ্চান্ন, ছোট বেলা থেকেই ঘানি ঘুড়ানো আওয়াজের সাথে তার বেড়ে ওঠা, কারন সেকালে সুফিয়া বেগমের বাবার বাড়িতেও ঘুরতো তেল বানানোর ঘানি, তার বাবাও পেশায় তেল বিক্রেতা ছিলো, সেসুবাদে ব্যাপারি বাড়ির মেয়ে সুফিয়া বেগমের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাবার সাথেও ঘানি ঘুড়ানোর কাজে সহযোগিতা করতো সে।
সুফিয়া বেগম চল্লিশ বছর আগে, জোত আতাউল্লাহ গ্রামের ব্যাপারি বাড়ির ছেলে, রজব আলীর বউ হয়ে আসে ।
স্বামীর বাড়ি এসে সংসারের হাল ধরতে এখানেও ঘানি টানা শুরু করতে হয় নববধূ সুফিয়াকে, চল্লিশ বছর ধরে টানা বুকের মাঝে চেপে ঘানি ঘুড়াতে হচ্ছে তাকে ।
সুফিয়া বেগম ও রজব আলীর সংসারে তিন মেয়ে ও দুই ছেলে । মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয়েছে, এক ছেলে পোশাক কারখানায় কর্মরত আরেক ছেলের বউ নিয়ে আলাদা সংসার । স্বামী রজব আলী নয় মাস আগে, অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে শ্বাসকষ্ট (এজমা) রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ।
তাই ঘানি ঘুড়ানো উপার্জনের উপর নির্ভরশীলত সুফিয়া বেগম, ঘানি থেকে তেল বানাতে ঘানির উপর দেড় মন ওজনের বড় পাথর তুলে দিতে হয় এবং তা বুকের সাথে লেপ্টে ঘুরতে হয় সারাদিন ।
প্রযুক্তির যুগে এসেও এমন অমানবিক কাজ চালিয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সুফিয়া বেগম জানান, ছেলে মেয়ে কেউ তাকে দেখাশোনা করে না, অভাবের সংসারে দুবেলা দুমুঠো ভাত খাওয়ার জন্য এই কাজ করছেন। মেশিন বা গরু কিনে এই কাজ করার সামর্থ্য তার নেই । চল্লিশ বছর ধরে ঘানি টানায় কোন ধরনের অসুস্থতায় ভুগছেন কিনা, জানতে চাইলে সুফিয়া বেগম বলেন এমনিতে বড় কোন অসুখ না হলেও সারাদিন ঘানি টানায় রাতে বুকের ব্যথায় ঘুমাতে পারেন না ।
আয় কেমন হয় জানতে চাইলে, সুফিয়া বেগম জানান দৈনিক পনেরো কেজির মতো সরিষা থেকে চার/পাঁচ কেজি তেল বানানো সম্ভব হয়, পাঁচ কেজি সরিষা ভাঙ্গিয়ে ১২০ টাকা মজুরি পাওয়া যায়, এহিসাবে তাদের দৈনিক আয় ৩৬০টাকা ।
প্রথম দিকে দুই জন মিলে এই কাজ করলেও, এখন তিনজন দরকার হয় । বাকি দুইজন পার্শ্ববর্তী বাড়ির মহিলাকে সহযোগিতার জন্য নিতে হয়, তিন জনে ভাগ করে নেন মজুরির টাকা ।
কেউ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে কিনা জানতে চাইলে, সুফিয়া বেগম জানান একাধিক এনজিও কর্মী এসেছে, আশ্বাস দিলেও কোন সহযোগিতাই মেলেনি তার ভাগ্যে।
কি ধরনের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন জানতে চাইলে , সুফিয়া বেগম জানান এখন ঘানি টানতে কোনভাবেই তার শরীর উপযোগী নয়,ঘানি ঘুড়ানোর জন্য এক জোড়া ষাড় বা বলদ গরু পেলে অমানবিক কষ্ট থেকে মুক্তি মিলবে তার।