এস,এম শাহাদৎ হোসাইন গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধিঃ বিচিত্র পেশার মানুষ ছুকু মিয়া। লাশ টানায় তার পেশা। গভীর রাতেও কল পেলে ভ্যান নিয়ে ছুটে যান তিনি। মরা, পচা ও গলা মানুষের দেহ ঘারে তুলে তারপর ভ্যানে নিয়ে সোজা মর্গে যান। ঝুলন্ত আর গলিত লাশ নিয়ে নানা অভিজ্ঞাতার কথা শোনালেন তিনি। গাইবান্ধার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের ছুকু মিয়ার বাড়ী। গাইবান্ধা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দুরে এ গ্রাম অবস্থিত। রাস্তার পাশে টিনের দোচালা ঘর তার। বেশ সাদামাটা মানুষ। বাপের একমাত্র ছেলে তিনি। সংসারে অভাবের কারণে ছোটবেলায় স্কুলে যেতে পারেননি। জমিতেও কাজ করতে পারেন না। বয়স যখন ১৪ বা ১৫ তখন বিয়ে করেন রেখা নামের এক নারীকে। তারপর অভাব আরও বেড়ে যায়। অভাবের তাড়নায় খুঁজতে থাকেন কাজ। পরিচয় হয় থানা পুলিশের সঙ্গে। তাদের পরামর্শে ৩৫ বছর আগে লাশ টানার কাজ শুরু করেন। প্রথম প্রথম মৃত মানুষ দেখলে ভয় লাগতো। তবে এ পেশা ছেড়ে দিলে ভাত জুটবে কোথায় থেকে। এর মধ্যে এক ছেলে ফিরোজ ও মেয়ে শরিফার জন্ম হয় তার সংসারে। স্ত্রী-সন্তান মিলে ৪ জনের সংসার। লাশ টানা ছাড়া অন্য কাজ না পেয়ে ছকু মিয়া সাহস নিয়ে পেশা হিসাবে বেছে নিতে বাধ্য হন। জেলার চার উপজেলায় কারো অস্বাভাবিক মৃত্যু হলেই ডাক পড়ে তার। কোথাও পচা লাশ পড়ে আছে সংবাদ পেলেই পুলিশ গিয়ে হাজির হয় ছুকুর বাড়িতে। তারপর দামদর ঠিক হলেই ভ্যান নিয়ে লাশের পাশে হাজির হন।তিনি বলেন, মরা লাশের খুব গন্ধ।তারপরেও বাধ্য হয়েই মরা পচা, গলিত, গলায় ফাঁস লাগানো, কবর থেকে গন্ধযুক্ত লাশ তোলার কাজ করি। এখন আর ভয় হয় না, পেটের ক্ষুধার কাছে ভয় হার মেনেছে। ছুকু মিয়া বলেন,পচা লাশ দেখে আর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে থাকা বিভৎস লাশ দেখে মানুষ দূরে সরে যায়। সরে যায় পোশাক পড়া অস্ত্রধারী পুলিশও। কিন্তু আমি একাই ফাঁসির ঝুলন্ত লাশ বুকে নিয়ে নিচে নামিয়ে আনি। অনেক সময় লাশের শরীরের পায়খানা প্রশ্রাব গায়ে লাগে। কি আর করার। মাটিতে পড়ে থাকা কয়েকদিনের পচা লাশ দুই হাত দিয়ে তুলি, তারপর ভ্যানে করে সোজা পুলিশের কথা মতো মর্গে চলে আসি। ঝুলন্ত লাশ মাটিতে নামিয়ে মর্গে নিলে এবং ঠিকানা মতো পৌঁছে দিলে তাকে দিতে হবে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। কবর অথবা মাটি থেকে পচা গলিত লাশ তুলতে তাকে দিতে হয় ৪ হাজার টাকা। আর অল্প সময়ের মরা মানুষের দেহ মর্গে নিয়ে যাওয়া ও ঠিকানা মতো পৌঁছে দিলে অন্তত ৩ হাজার টাকা পান তিনি। গাইবান্ধা সদর, পলাশবাড়ি, সাঘাটা ও ফুলছড়ি থানা এলাকার মৃতদেহ বহন করেন তিনি। লোকজন দূরে দাঁড়িয়ে দেখলেও ছকু মিয়া একাই দুই হাতে লাশ বুকে জড়িয়ে তোলেন তার ভ্যানে। এই কাজের জন্য মজুরি হিসাবে যা পান, তাতে তার পরিবারের মুখে দুই বেলা খাবার জোটে। লাশ ছাড়া জীবন্ত মানুষ ছুকুর ভ্যানে উঠে না। তারা ভয় পায় বলে মাসের পর মাস ভ্যানটি তার বাড়িতে পড়ে থাকে। এ কাজের ফাঁকে যদি অন্য ভাড়া জুটতো, তাহলে তার সংসার ভালোভাবে চলতো। পুলিশের কাছে তার ফোন নম্বর থাকলেও সরকারি খাতায় তার কোনো নাম নেই। তিনি কোনো বেতনও পান না। তবু লাশ টানেন পেটের দায়ে। গাইবান্ধা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুদার রহমান বলেন, লাশ টানার কাজ কেউ করতে চায় না, ভয়ে মরা মানুষের কাছ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে মানুষ। আমি মনে করি ছুকু মিয়া একটি মহৎ কাজের সঙ্গে জড়িত। ফাঁসির বিভৎস লাশ থেকে শুরু করে, পড়ে থাকা পচা-গলা একটি মরদেহ তিনি হাতে বহন করেন। এমন সাহস ক’জনের আছে? আর এ কাজও কেউ করতে চায় না। সে কারণে ছকু মিয়ার পাওনা আরও অনেক বেশি হওয়া উচিৎ।