এস এম শাহাদৎ হোসাইন গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি দৈনিক শিরোমণিঃ ব্যবহার না থাকায় ৮৩ বছরের রেল ফেরির ইতি টানতে চায় গাইবান্ধা রেলওয়ের মেরিন বিভাগ। ইতোমধ্যে পাঁচটি নৌযান নিলামে বিক্রয় করা হয়েছে। বাকী নৌযানগুলো বিক্রয় করার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। গাইবান্ধা রেলওয়ের মেরিন বিভাগের পরিদর্শক মাজদার রহমান বলেন, ফেরিসহ এখানে মোট ১১টি নৌযান ছিল। তার মধ্যে পাঁচটি বিক্রয় হয়েছে। পাঁচটির একটি ঢাকার মিরপুরের পূর্ব আহম্মদ নগর এলাকার মের্সাস জেআর এন্টারপ্রাইজ ক্রয় করে নিয়েছে। জিওয়ান নামে সেই ফেরিটি ৭৬ লক্ষ টাকায় নিলামে বিক্রি করা হয়েছে বলে শুনেছি। জিওয়ানের ওজন আনুমানিক ৫০০ মেট্রিকটন। অন্য চারটি নৌযান সম্প্রতি নিলামে বিক্রি করা হলেও এখনও হস্তান্তর করা হয়নি তিনি আরও বলেন, সেগুলো বালাসিঘাটে রয়েছে হস্তান্তরের অপেক্ষায়। রেলওয়ের গাইবান্ধা মেরিন বিভাগের অতিরিক্ত সুপার ও রেলওয়ে লালমনিরহাট অঞ্চলের যন্ত্র প্রকৌশলী রাসেল আলম বলেন, পাঁচটি বিক্রয় করা হয়েছে। অবশিষ্ট ছয়টি বিক্রয়ের প্রক্রিয়া চলছে। হয়ত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। তবে বিক্রয়ের আদেশ হয়নি। হয়ত বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন তা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, রাজশাহীর প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে দরপত্র আহ্বান ও বিক্রি করা হচ্ছে এসব। সেখানকার কর্তৃপক্ষ সবকিছু জানে। রাজশাহীর প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক রাশেদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মোবাইল ফোনে তথ্য দেওয়া যাবে না। এখানে গোপনীয়তা অবলম্বন করা হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি আর কিছু বলতে চাননি। লালমনিরহাটের বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক শাহ সুফি নূর মোহাম্মদ ফোনে বলেন, এসব নৌযান রেলওয়ের প্রয়োজন নেই। এগুলো রেলের কোনো কাজে লাগছে না। চলাচলেরও উপযোগী নয়। নৌযানগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নৌপথও চালু নেই। তাই এসব নৌযান বিক্রয় করা হচ্ছে। গাইবান্ধায় বালাসিঘাটে গিয়ে দেখা যায়, যমুনা তীরে কিছু নৌযান নোঙর করে রাখা হয়েছে। শিশুরা সেখানে খেলাধুলা করছে। এর পাশ ঘেঁষে নৌকা চলাচল করছে। বর্তমানে ৭/৮ জন কর্মচারী বালাসিঘাটের নৌযানগুলো পাহারা দিচ্ছেন। নিরাপত্তাকর্মী মণীন্দ্রনাথ বলেন, তারা কয়েকজন এগুলো পাহারা দেন। এর বেশি কিছু জানেন না। তবে রেলওয়ের রাজশাহী পশ্চিমাঞ্চল থেকে এসব নৌযান নিলামে বিক্রয় করা হচ্ছে বলে শুনেছি। যারা ক্রয় করেছেন তাদের লোকজন মাঝে মাঝে এসে এগুলো নিয়ে যাচ্ছে। গাইবান্ধা রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার আবুল কাশেম বলেন, ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে তিস্তামুখঘাট-বাহাদুরাবাদ নৌপথ চালু করে। এপাড়ে ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখ ঘাট আর ওপারে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ ঘাট। ১৯৯০ সালে তিস্তামুখ ঘাট একই উপজেলার বালাসিতে স্থানান্তর করা হয়। তিনি আরও বলেন, তিস্তামুখঘাট-বাহাদুরাবাদ নৌপথ চালুর মাধ্যমে ঢাকা-দিনাজপুর রেল যোগাযোগ শুরু হয়। উত্তরাঞ্চলের আট জেলার মানুষ ট্রেনে করে তিস্তামুখ ঘাটে যেত। তিস্তামুখ ঘাট-বাহাদুরাবাদ নৌপথ ফেরিতে পার হত।ওপারে বাহাদুরাবাদ গিয়ে আবার ট্রেনে উঠে ঢাকায় যেত।আর ওয়াগনগুলো সরাসরি ফেরিতে পার হত।সে সময় কম খরচে নিরাপদে ঢাকায় যাতায়াত করা যেত। তিস্তামুখঘাট-বাহাদুরাবাদ নৌপথ চালুর পর রেলওয়ের মেরিন বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয় জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে গাইবান্ধা মেরিন বিভাগে ৩০ থেকে ৩৫ জনের লোকবল রয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালের দিকে অকেজো দেখিয়ে বালাসিঘাট থেকে একটি কারখানাসহ ১৯টি নৌযান নিলামে বিক্রি করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।আবুল কাশেম বলেন, যমুনায় নাব্য সংকট দেখা দেওয়ায় ১৯৯৬ সালের দিকে বালাসি-বাহাদুরাবাদ নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধের উপক্রম হয়। এরই মধ্যে ১৯৯৮ সালের জুন যমুনায় বঙ্গবন্ধ সেতু চালু হয়। ফলে ২০০০ সালে এই নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অকার্যকর হয়ে পড়ে বালাসিঘাট।তখন থেকে বালাসি ঘাটে এসব নৌযান পড়ে রয়েছে। উনিশ শতকের পৃথিবীতে প্রথম রেলওয়ে চালু হয়, যা অল্প সময়ের মধ্যেই যোগাযোগে বিপ্লব নিয়ে আসে। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ১৮২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডে বিশ্বের প্রথম রেলওয়ে চালু হয়। ইংল্যান্ডের স্টকটন থেকে ডার্লিংটন পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার পথ সবার জন্য খুলে দেওয়ায়। এর ৩০ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রেললাইন চালু হয়। ভারতের মুম্বাই থেকে ৩৩ কিলোমিটার রেললাইন চালু হয় ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল। আর পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া থেকে হুগলি ৩৮ কিলোমিটার লাইন চালু হয় ১৮৫৪ সালে। এটাই অবিভক্ত বাংলার প্রথম রেলপথ। স্বাধীন বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমায় রেল চালু হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর কুষ্টিয়ার দর্শনা থেকে জগতী পর্যন্ত ৫৩.১১ কিলোমিটার। এরও প্রায় এক যুগ পরে দিনাজপুর হয়ে উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন জেলায় বিস্তৃত হয় রেলপথ। তার ধারাবাহিকতায় তিস্তামুখ ঘাট-বাহাদুরাবাদ ফেরি চালু করা হয়, যাতে ঢাকা-ময়মনসিংহসহ এই এলাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গ ও কলকাতার যোগাযোগ সহজ হয়।