সেলিম রেজা সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি দৈনিক শিরোমণিঃ সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে। প্রতি হাটে লেনদেন হয় ১৫০-২০০ কোটি টাকার।লেনদেনের বিশাল অঙ্কের কারণে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের কাপড়ের হাটকে বলা হয় দেশের সবচেয়ে বড় কাপড়ের হাট।
বিশাল আড়তের ভেতর ছোট ছোট দোকান, অগুনতি পাইকার-খদ্দেরের আনাগোনা, দরদামের হাঁকাহাকি, চারদিকে কাপড়ের বান্ডিল আর গাঁটের ছড়াছড়ি হাটবারগুলোয় শাহজাদপুর কাপড়ের হাটের চিত্র এটি। সপ্তাহের রবি ও বুধ-এ দু’দিন রবীন্দ্র কাছাড়ি বাড়ির গা ঘেঁষে বসে এ হাট। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সীমান্তের ওপার থেকেও আসেন ক্রেতারা। পাইকার খদ্দেরের হাঁকডাক আর কোলাহলে তিল ধারণের জায়গা থাকে না সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের এই কাপড়ের হাটে।একসময় শাহজাদপুরে হাট বসত সোম ও বৃহস্পতিবার। কাপড়ের বাজারের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু কাপড়ের বিক্রি-বাট্টার জন্য আলাদা করে নির্ধারণ করা হয় দুটো হাটবার। রবিবার ও বুধবার। হাট শুরু হয় মূলত শনিবার ও মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই, রবি ও বুধবারে হাটের বিক্রি হয় তুলনামূলক বিক্রেতারা জানান, হাটবারগুলোয় এখানে খুচরা-পাইকারি বিভিন্ন দরে কয়েকশ কোটি টাকার বিক্রি-বাট্টা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকারি খরিদ্দাররা, যাদের পাইকার নামেও পরিচিত, এসে পাইকারি দরে কাপড় কিনে নিয়ে যান। দেশের বাইরে থেকেও খদ্দের আসে। এ হাটের শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ কাপড় ভারতীয় পাইকাররা কিনে নিয়ে যায়। গত আট বছর ধরে এই হাটে ভারতীয় পাইকারদের সঙ্গে ব্যবসা করছেন সোনালি শাড়ি হাউস এর মালিক সিরাজুল ইসলাম। হাটের বিক্রি-বাট্টার বিষয়ে বলেন, ইন্ডিয়ান পাইকাররাই আমার দোকানের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। আগে পাকিস্তান থেকেও খরিদ্দার আসত,, এখন আর তারা আসে না। দেশের মধ্যে চিটাগাঙের ব্যবসায়ীরা বেশি আসে। একটা সময় ছিল যখন লেনদেন হইতো ক্যাশে। এখন ট্যাকার অঙ্ক হাজার বা লাখ যাই হোক সব অনলাইন ব্যাংকিংয়েই হয়। শাড়ি বা লুঙ্গির দোকানগুলোয় খোঁজ নিয়ে দেখা যায় প্রায় প্রতিটি দোকানের পাইকারি খরিদ্দার বাঁধা। ক্রেতা-বিক্রেতার এমন বিশ্বস্ততার সম্পর্ক নির্মিত হতে অনেকদিন সময় লাগে। এমনও দোকান পাওয়া গেছে যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক কয়েক প্রজন্মের। গৌড় বসাক নামক একজন ভারতীয় পাইকার জানান, তিনি প্রায় প্রতি মাসেই পাইকারি দরে শাড়ি কিনতে শাহজাদপুর হাটে আসেন। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমানে গৌড় এন্ড সন্স নামে তার একটি শাড়ির দোকান আছে। কথায় কথায় তিনি বলেন, তাঁতের শাড়ি ভারতেও উৎপাদিত হয়। গুণে-মানে মোটামুটি ভালোই, কিন্তু দামে বেশি। বাংলাদেশের কাপড়ের হাটগুলোয় ভারতের বাজারের চেয়ে বেশ কম দামে তাঁতের কাপড় পাওয়া যায়। তাই এদিকে আসি আমরা। গৌড় বসাকের মতো চিত্তরঞ্জন বসাক, সুকুমার ঘোষ, কাশী নন্দীও নিয়মিত বাংলাদেশের হাটগুলোয় যাতায়াত করেন। শাহজাদপুর হাটে মোটামুটি তাদের দোকান বাধা। চট্টগ্রাম থেকে আগত একজন পাইকার বলেন, চট্টগ্রামে শাহজাদপুরের শাড়ি-লুঙ্গির ব্যাপক চাহিদা। এখান থেকে কাপড় নিয়ে আমরা নিজেদের দোকানের ব্র্যান্ডের মার্কা লাগিয়ে শো-রুমে খুচরা দরে সেগুলো বিক্রি করি। কাপড়ের বিক্রি কমে যাওয়ায় অনেকসময় পুরো টাকা পরিশোধ করতে পারি না, তখন বাকিতে মাল নিয়ে সেগুলো বিক্রি করে তারপর দেনা পরিশোধ করতে হয়। বাকিতে কাপড় দেওয়ার বিষয়টি নির্ধারিত হয় বিশ্বস্ততার জায়গা থেকে। খরিদ্দার বিশ্বস্ত হলে বিক্রেতারা কোটি টাকার উপরেও বাকি দেয়। কাপড়ের বাজারে ধস নামলে বা বিক্রি-বাট্টা কমে গেলে অনেক ব্যবসায়ীর মূলধন বা পুঁজি আটকা পড়ে যায়,,সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের কাপড়ের হাটকে বলা হয় দেশের সবচেয়ে বড় কাপড়ের হাট। এছাড়া, পাবনার আতাইকুলার হাট সিরাজগঞ্জের সোহাগপুরের হাট এনায়েতপুরের হাট ও টাঙ্গাইলের করটিয়ার হাট, প্রসিদ্ধ ও বিখ্যাত। তবে এ হাটগুলোর তুলনায় শাহজাদপুর হাটের বিশেষত্ব হল এখানে গ্রে কাপড়ের চেয়ে প্রক্রিয়াকৃত কাপড়ের বাজার ভালো।গ্রে-কাপড় মানে তাঁত থেকে সদ্য নামানো কাপড়,এ ধরনের কাপড় সরাসরি পরিধানের উপযুক্ত নয়।এ কাপড়ের অসুবিধা হল এটিকে ক্যালেন্ডারিং করে খুচরা বাজারে ছাড়তে হয়। তাই, বিদেশি বা বহিরাগত খরিদ্দাররা একদম রেডিমেড কাপড় কিনতে বেশি আগ্রহী হয়। আর শাহজাদপুর কাপড়ের হাট রেডিমেড কাপড়ের জন্য প্রসিদ্ধ। তবে, সিরাজগঞ্জের অন্য দুই বড় হাট, সোহাগপুর ও এনায়েতপুর হাটে গ্রে কাপড় বেশি চলে। শাহজাদপুরের অনেক পাইকার সেখান থেকে গ্রে কাপড় নিয়ে এসে প্রক্রিয়াজাত করে কাপড়ের গায়ে নিজেদের ব্র্যান্ডের লোগো লাগিয়ে বাজারে ছাড়ে।শাহজাদপুর কাপড়ের হাট এক বিস্তৃত মহাযজ্ঞ, প্রতিবছর এ হাটের ইজারা ডাকে শাহজাদপুর পৌরসভা, হাটটি পৌরসভার দ্বারিয়াপুর গ্রামের অন্তর্গত হওয়ায় পৌরসভা হাট ডাকার এখতিয়ার লাভ করেছে। একজন ব্যক্তির নামে একটি গোষ্ঠী হাটের ইজারা ধরে থাকে।সাধারণত প্রতিবছর স্থানীয় প্রভাবশালী তথা সরকারদলীয় ব্যক্তিবর্গই আর্থিক প্রতিপন্নতার দিক দিয়ে সবাইকে ছাপিয়ে হাটের ইজারা গ্রহণ করে। এবছর, হাট ইজারার সর্বোচ্চ ডাক উঠেছিল প্রায় ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। যারা বা যিনি হাটের ইজারা লাভ করেন, তারা হাটকে আবার কয়েকজনের ভেতর বণ্টন করে দেন। এ বণ্টনটি করা হয় হাটের গলি ধরে ধরে। গলিগুলোকে পট্টি নামেও ডাকা হয় অনেকসময়, যারা হাটের গলিগুলোর ইজারা লাভ করেন তারা স্ব স্ব গলিগুলো থেকে বিভিন্ন খাজনা, চাঁদা উত্তোলন করে থাকেন। সেখান থেকে মূল ইজারাদারকে কিছু প্রদান করা হয়। উদ্বৃত্ত অংশটি তাদের লভ্যাংশ। এ বিষয়ে শাহজাদপুর তাঁতবস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতি’র সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল ইসলাম সাজু বলেন, খাজনা বা চাঁদার বিনিময়ে ইজারাদারেরা হাটে শৃঙ্খলা বিধান করেন এবং ব্যবসায়ীদের ব্যবসাজনিত নিরাপত্তার দ্বায়িত্ব পালন করেন।
১ view