মো.সোহেল রানা, মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রতিনিধিঃ মুন্সীগঞ্জ লৌহজং মাওয়া শিমুলিয়া ঘাট মাদারীপুরের বাংলাবাজার নৌরুটে সীমিত ফেরি চলাচল করায় চরম দুর্ভোগে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। এছাড়াও ঢাকা ছেড়ে যাওয়াদের ঘাটে রাত-দিন ফেরির অপেক্ষায় থেকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জানা যায়, দেশের কর্মসংস্থানের সিংহভাগ রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন কাজের সন্ধানে রাজধানীমুখী হতেন। প্রতিদিনই কর্মসংস্থান বা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ঢাকায় আসত মানুষ।
ভাড়াটিয়ারা বছরের পর বছর বাসার উচ্চ ভাড়া দিয়ে আসছেন। কিন্তু করোনাভাইরাস পরবর্তী পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে বাসা ভাড়ার চিত্রও। করোনার কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেক মানুষের শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে অনেক মানুষ হতদরিদ্র হয়েছেন, ফলে আগের ভাড়ার ভার বইতে পারছেন না তারা। ফলে ছেড়ে দিচ্ছেন বাসা, ছেড়ে দিচ্ছেন ঢাকাও। এই কর্মজীবী-নিম্নআয়ের মানুষেরা বলছেন, সম্প্রতি দেশে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহণ ভাড়াও বেড়েছে। ফলে বাসা-বাড়ি থেকে কর্মস্থলে আসা-যাওয়ার খরচ বেড়েছে বহুগুণ।
এছাড়া পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। এই অতিরিক্ত খরচের ভারে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে কেউ কেউ নিজে রাজধানীতে মেসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের পাঠিয়ে দিচ্ছেন গ্রামের বাড়ি। আবার কেউ কেউ রাজধানীর সঙ্গে কর্মজীবনের ইতি টেনে গ্রামমুখী হচ্ছেন। গতকাল মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে দেখা যায় জিনিসপত্রসহ বেশ কয়েকটি পিকআপে রাজধানী ঢাকা ছাড়ছেন কয়েকটি পরিবার।
শিমুলিয়া ঘাটে সীমিত ফেরি চলাচলের কারণে ঢাকা ছেড়ে যাওয়াদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ রুটে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কে-টাইপ ৪টি ফেরি দিয়ে সীমিত যানবাহন পারাপার করায় প্রতিদিনই ঘাট এলাকায় দীর্ঘসময় আটকা পড়ে থাকছে শত শত যাত্রী ও পণ্যবাহী গাড়ি।
সরেজমিনে দেখা যায়, কাঁচপুরে ওপেক্স গ্রুপ নামে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন নড়াইলের শিরিন বেগম। চার হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে সপরিবারে বসবাস করতেন। গত তিন মাস আগে পোশাক কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। কাজ হারিয়ে তিনি নড়াইলে গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, গতকাল ঘাটে আসছি, ফেরির সিরিয়ালে এখনো অপেক্ষা করছি। সারা রাত শীতের মধ্য গাড়িতে আমাদের অনেক কষ্ট হয়েছে।
ফতুল্লা থেকে পিকআপভ্যানে করে বাসাবাড়ির মালামাল নিয়ে আসা তানিয়া বেগম বলেন, তার স্বামী আচার বিক্রি করতেন। ব্যবসা মন্দার কারণে ঘরভাড়া দিতে পারতেছি না। দেশ থেকে টাকা এনে রুম ভাড়া পরিশোধ করেছি। পোলাপান নিয়ে খাওয়াদাওয়ার সমস্যা হয়ে যাইতেছে। এ জন্য নিজ গ্রামে সপরিবারে চলে যাচ্ছি। ছেলে-মেয়ে নিয়ে শীতের মধ্য সারা রাত ঘাটে আমাদের খুব কষ্ট হয়েছে।
শরিফ নামের এক যাত্রী জানান, সাভারে পোশাক কারখানায় স্বামী-স্ত্রী দু’জন কাজ করতেন। তার স্ত্রীর চাকরি চলে যায়। তার একার আয় দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা। তাদের আর ঢাকায় বসবাস করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ঢাকার বাসা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে যাচ্ছেন। তিনি আরও জানান, সাভার থেকে গতকাল সকাল ৬টায় ঘাটে আসছি, বরিশাল যাবো। বাসাবাড়ির মালামাল ও পরিবার নিয়ে এখনো ঘাটে সিরিয়ালে আছি।
চালকরা জানান, তাদের অনেকেই রাত ২টা থেকে দুপুর পর্যন্ত লাইনে থেকেও ফেরিতে ওঠার সুযোগ পাচ্ছেন না। অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। যাত্রীদের অভিযোগ, শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা বাড়তি টাকা নিয়ে কিছু যানবাহনকে ফেরিতে ওঠার সুযোগ করে দেয়। আবার ‘ভিআইপি’ টোকেনেও অনেক যান পার করা হচ্ছে। এতে লাইনের পেছনে থেকেও অনেক যানবাহন আগে ফেরি পার হচ্ছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) শিমুলিয়া ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) ফয়সাল দৈনিক শিরোমনি কে জানান, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি ২টি রুটে ৬টি ফেরিতে যানবাহন পারাপার হচ্ছে। সীমিত ফেরি চলাচলের কারণে প্রায়ই দিনশেষে কোনো দিন অর্ধশতাধিক, কোনো দিন শতাধিক যানবাহন ঘাটে আটকা পড়ছে। ফলে আটকে পড়া গাড়িগুলোকে পরের দিনে ফেরি পারাপারের জন্য হয় ঘাটেই রাত কাটাতে হচ্ছে, নয়তো ফিরে যেতে হচ্ছে ঢাকায়। এর সমাধানে ফেরির সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন।
মাওয়া ট্রাফিক পুলিশের ইনচার্জ মো. জাকির হেসেন জানান, ‘ভিআইপি’ যান পার করা হচ্ছে না। ফেরি সীমিত চলাচলে যানবাহন আটকা পড়ছে। ঘাটে দেড় শতাধিক যানবাহন পারাপারে অপেক্ষায় আছে।