পালটে যাচ্ছে ২০ জেলার বাস চলাচলের রুট। পদ্মার দক্ষিণ পাড়ে থাকা এসব জেলায় আগে রাজধানী থেকে বাস যেত দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া হয়ে। ২৫ জুনের পর সেগুলো পার হবে পদ্মা সেতু। এজন্য চলছে নানা আয়োজন।৬০ পরিবহণ কোম্পানি প্রায় দেড় হাজার বাস সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।এসব রুটে দূরত্ব কমবে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি। সেইসঙ্গে ফেরি পারের ঝক্কি না থাকায় এখনকার তুলনায় প্রায় ২ ঘণ্টা কম লাগবে গন্তব্যে পৌঁছাতে। এরইমধ্যে ১৩ রুটের ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে বিআরটিএ।পদ্মার দক্ষিণ পাড়ে রয়েছে ২১ জেলা। বরিশাল ও খুলনা বিভাগের ১৬টি, বাকিগুলো ঢাকার। এসব জেলায় যাতায়াতে যাত্রীবাহী বাসগুলোর নিয়মিত রুট হচ্ছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া।গাবতলী থেকে ছেড়ে পাটুরিয়া ঘাটে ফেরিতে উঠে পদ্মা পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাত সেগুলো। আরিচা হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে এসব বাসকে পাড়ি দিতে হয় ১০০ কিলোমিটার অতিরিক্ত পথ। সেই সঙ্গে ফেরিঘাটের যন্ত্রণা তো রয়েছেই, অন্য নানা ঝামেলাতেও পড়তে হতো যাত্রীদের।
গাবতলী থেকে ছেড়ে ১৯৮৬ সালে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্টে মাওয়া-কাঁঠালবাড়ি রুটে ফেরি চলাচল শুরু হলে নতুন পথের খোঁজ পান ২১ জেলার মানুষ। এ রুটে চলাচলের ক্ষেত্রে দূরত্ব কমে যায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি। আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হতে থাকে রুটটি। পণ্যবাহী ট্রাকের পাশাপাশি ছোট গাড়ি এবং কিছু বাসও চলতে শুরু করে। তবে ফেরির যন্ত্রণা আর ভাঙা সড়কের কারণে মূলধারার বাসগুলো আসেনি এ রুটে।বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বদলে যেতে শুরু করে দক্ষিণাঞ্চলের সড়কের চিত্র। একের পর এক সেতু নির্মাণে বন্ধ হতে থাকে ফেরি। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে পায়রা সেতু চালু হলে ভোলা ছাড়া অন্য সব জেলা সদরের সঙ্গে স্থাপিত হয় কাঁঠালবাড়ির সরাসরি সড়ক যোগাযোগ। রাজধানীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় শুধু পদ্মা নদী। সেখানে এবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে সেতু। ২৫ জুন তা উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ২৬ জুন তা খুলে দেওয়া হবে যান চলাচলের জন্য।পদ্মা সেতু চালু হওয়া মানে রাজধানী ঢাকা থেকে দক্ষিণের ২১ জেলার দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারের বেশি কমে যাওয়া। নানা ঝক্কি থেকে মুক্তি। ফলে এটিই যে হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সড়ক পথে যাতায়াতের প্রধান রুট তা আর অনুধাবনে বাকি নেই পরিবহণ মালিকদের। এজন্য রুট পারমিট গ্রহণসহ নানা প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।নতুন রুটে বেশি যাত্রী পরিবহণের আশায় একসঙ্গে শতাধিক বাস নির্মাণে হাত দিয়েছেন শরীয়তপুর জেলায় বাস মালিকরা। পর্যায়ক্রমে আরও বাস বাড়াতে চান তারা। ফরিদপুর-মাদারীপুর জেলার বাস মালিকরাও একইভাবে হাত দিয়েছেন নতুন বাস নির্মাণে। প্রস্তুতি নিতে পিছিয়ে নেই সারা দেশে চলাচলকারী পরিবহণ গ্রুপগুলোও। ঢাকা-বরিশাল-কুয়াকাটা নতুন রুটে বাস চালাতে গ্রিনলাইন পরিবহণ চালক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।
এতদিন যেসব পরিবহণ মালিক গাবতলী থেকে ছেড়ে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া হয়ে গন্তব্যে বাস পাঠাতেন তারা এবার আসছেন সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে।ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী সাকুরা পরিবহণ (প্রা.) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমার কোম্পানিতে থাকা ৭০টি বাস মূলত বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন রুটে চলাচল করে। সেতু উদ্বোধনের পর পদ্মা পাড়ি দিয়েই চলাচল করব আমরা। এতে সময় ও দূরত্ব দুটোই কমবে।’তবে পদ্মা সেতুর টোল ও নতুন রুটগুলোতে ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি। হুমায়ুন কবির বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে এসব নির্ধারণ করা। এ পথে বরিশাল পর্যন্ত যেতে আগের তুলনায় বেশি খরচ হবে। সরকারের কাছে বিষয়টি বিবেচনার আবেদন করছি।’
বাংলাদেশের পরিবহণ ব্যবসায় অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান হানিফ পরিবহণের মালিক কফিলউদ্দিন বলেন, ‘গাবতলী থেকে বরিশাল-খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় দৈনিক দেড় হাজারের বেশি বাস চলাচল করে। অন্তত ৬০টি পরিবহণ কোম্পানির বাস চলে এসব রুটে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এ বাসগুলো চলে যাবে সায়েদাবাদ টার্মিনালে। হাতেগোনা ৩-৪টি বড় কোম্পানি ছাড়া অন্য কোম্পানিগুলোর কোনো কাউন্টার নেই সেখানে। নতুন করে যাওয়া ১৪-১৫শ বাস রাখার মতো কোনো জায়গাও নেই। বিষয়টি নিয়ে টেনশনে আছি আমরা।’বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক এ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে শুধু এই দেড় হাজারই নয়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে যুক্ত হবে আরও নতুন নতুন পরিবহণ। এতদিন ফেরি পারাপারের ঝামেলার কারণে অনেক বিলাসবহুল বাস চলেনি এ রুটে। সেগুলোও এখন যুক্ত হবে। রাজবাড়ী বাদে অন্য সব জেলার বাসই পদ্মা পাড়ি দিয়ে ছুটবে দক্ষিণে। এত বিপুলসংখ্যক বাসের জন্য সায়েদাবাদ টার্মিনালের আয়তন বৃদ্ধি বা রাজধানীর বাইরে পদ্মা সেতুমুখী এলাকায় নতুন টার্মিনাল করা এখন সময়ের দাবি। সরকারের উচিত বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া।’বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘পদ্মা সেতু পালটে দেবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক চিত্র। বরিশাল বা খুলনার যে কোনো জায়গা থেকে আগের তুলনায় কম করে হলেও দুই ঘণ্টা আগে পৌঁছানো যাবে ঢাকায়। আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন বাস্তব। একই ধারায় বাকি পরিবর্তন এবং প্রয়োজনগুলোও সময়ের সঙ্গে পূরণ হবে এমনটাই আশা করছি।’