ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকে চার মাসে বেশ কয়েকবার রণকৌশল পরিবর্তন করেছে রাশিয়া। কখনও পুরো দেশে একসঙ্গে বোমাবর্ষণ, কখনও স্থল অভিযান, আবার কখনও আক্রমণ করছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু ঘিরে। এভাবে ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় এই রাষ্ট্রে একের পর এক টার্গেট পূরণ করছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন। দখলে নিয়েছেন সীমান্তবর্তী বন্দরনগরী মারিউপোল থেকে উত্তর দিকে লুহানস্ক পর্যন্ত। হামলা অব্যাহত রাখা হয়েছে আরও উত্তরের নগরী খারকিভে। তবে নতুন করে হামলার গতি-প্রকৃতি মূল্যায়ন করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, অদূরভবিষ্যতে সমুদ্র হারাবে ইউক্রেন। ইতোমধ্যে আজভ সাগর ও কৃষ্ণ সাগর তীরবর্তী অধিকাংশ এলাকা বেদখল হয়েছে। এবার হামলা হচ্ছে অবশিষ্ট উপকূলীয় এলাকায়।
ইউক্রেনের উপকূলীয় অঞ্চল খেরসনের নিপের নদী পর্যন্ত বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে পুতিনের বাহিনী। এ অংশের মারিউপোল, বারদিয়ানস্কসহ কয়েকটি বন্দর থেকে শুরু হয়েছে রপ্তানি, যার পরিচালনায় আছেন রুশসমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী সেনারা। গত বৃহস্পতিবারও বারদিয়ানস্ক থেকে প্রায় সাত হাজার টন শস্য নিয়ে একটি জাহাজ কৃষ্ণ সাগর অভিমুখে ছেড়ে গেছে। রুশ সেনারা এখন খেরসন থেকে মাইকোলাইভ, ওডেশা, স্নেক আইল্যান্ডসহ সমুদ্রসীমার বাকি অংশ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এর অংশ হিসেবে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা জোরদার করা হয়েছে। হামলার ১২৯তম দিনে শনিবার মাইকোলাইভ ও দোনবাসে অন্তত পাঁচটি সামরিক ঘাঁটি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছে। ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে খেরসনের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল জাপোরিজজিয়াতেও। সেখানে তিনটি গুদামে বোমাবর্ষণের দাবি করা হয়েছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি হামলার শুরুর দিকে স্নেক আইল্যান্ড দখল করে নেয় রাশিয়া। এতদিন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও বৃহস্পতিবার জেলেনস্কির বাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে দ্বীপটি ছেড়ে যান রুশ সেনারা। এর পরই তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা শুরু করেন পশ্চিমা নেতারা। বিষয়টিকে ‘বিজয়’ আখ্যা দিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, ‘কিয়েভ ও খারকিভে ইউক্রেনের সেনারা যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, ঠিক সেভাবে বীরত্ব দেখিয়ে স্নেক আইল্যান্ড থেকে রুশ বাহিনীকে তাড়িয়েছেন তাঁরা।’ জেলেনস্কি বলেন, পুতিনের বাহিনীর দ্বীপটি ছেড়ে যাওয়া কৃষ্ণ সাগরের পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনবে। তবে এখনও বেশি কিছু আশা করার পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, কারণ তাঁরা যেকোনো সময় আবার ফিরে আসতে পারেন। এদিকে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির জন্য জাতিসংঘ যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার প্রতি সদিচ্ছা দেখাতেই দ্বীপটি থেকে সৈন্যদের ফেরানো হয়েছে।
স্নেক আইল্যান্ড নিয়ে উভয় পক্ষের নেতাদের পাল্টাপাল্টি মন্তব্যের একদিন পরই সেখানে ফের হামলা হয়েছে। নতুন করে শুক্রবার দ্বীপটিতে ভয়ংকর ফসফরাস বোমা ফেলা হয়েছে বলে ইউক্রেন অভিযোগ করেছে। দেশটির সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ ভেলেরিয়ে জালুজনি বলেন, রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত ক্রিমিয়া থেকে এক জোড়া এসইউ-৩০ যুদ্ধবিমান উড়ে আসে এবং ফসফরাস বোমা ফেলে।
ইউক্রেনের সেনাবাহিনী আরও দাবি করেছে, তাঁরাও রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্দান্ত লড়ছেন। গতকাল দেশটির পূর্বাঞ্চলে রুশ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বোমা হামলা চালিয়েছেন তাঁরা। এ সময় ব্যাপক বিস্ম্ফোরণে কেঁপে ওঠে একটি অস্ত্রাগার এবং আকাশে প্রচণ্ড ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। তবে এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও ঘটনাস্থল সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এদিকে জেলেনস্কির সেনাদের শক্তি বাড়াতে নতুন করে আরও ৮২০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। শুক্রবার তিনি ন্যাটোর নেতাদের এক বৈঠকে বলেন, এই প্যাকেজে ভূমি থেকে উড়ন্ত বস্তুতে আঘাত হানতে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র, চারটি রাডারসহ বেশ কিছু গোলাবারুদ দেওয়া হবে। এভাবে ইউক্রেনকে সহায়তা করায় এবং রাশিয়ার ওপর দফায় দফায় নানা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় পশ্চিমাদের সঙ্গে কূটনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে নানা চাপ সৃষ্টির পরও দেশটি থেকে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি কিনছে ইউরোপ। গতকাল ইউক্রেনের সুজা প্রবেশপথ দিয়ে যাওয়া গ্যাসের পরিমাণ ছিল চার কোটি ২০ লাখ ঘনমিটার। এদিকে ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে গিয়ে আরও দুই ব্রিটিশ নাগরিক আটক হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে রাশিয়ার বিপক্ষে লড়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। সূত্র :এএফপি, আলজাজিরা।