রইচ আহম্মেদ, বিশেষ প্রতিনিধি,মান্দা: যারা ভ্রমনপিপাসু এই পতিসরে আসতে চাইলে ট্রেনে, বাসে, সিএনজি, অটোরিকশা ও নদী পথে আসতে পারবেন। নওগাঁর আত্রাই উপজেলার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রেলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভালো। তাই নিঃসন্দেহে ট্রেনে আসতে পারেন এখানে। ঢাকা থেকে আন্তঃনগর ট্রেন নীলসাগর, লালমনি এক্সপ্রেস অথবা দ্রুতযানে চড়ে প্রথমে আত্রাই আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকা। অথবা বাসযোগে নওগাঁ বা নাটোরে এসে সেখান থেকে আত্রাই হয়ে পতিসর। নওগাঁ থেকে পতিসরের দূরত্ব ৩৬ কিলোমিটার। বাসে ভাড়া লাগবে ঢাকা-নাটোর ৪০০ টাকা এবং ঢাকা-নওগাঁ ৪৫০ টাকা। কেউ চাইলে বর্ষা মৌসুমে নাটোর হতে নৌকাযোগেও সরাসরি আসতে পারেন। নওগাঁ থেকে আত্রাই আসার একমাত্র যান হলো সিএনজিচালিত অটোরিকশা। ভাড়া পড়বে ৮০ টাকা। চাইলে মিনিবাস রিজার্ভ করেও আসা যাবে। আত্রাই থেকে পতিসরের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। আত্রাই থেকে পতিসর আসতে হলে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা চার্জার ভ্যানে আসা যাবে। এ ক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ৭০ টাকা করে।নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৬ কিলোমিটার দক্ষিণে আত্রাই উপজেলার নাগর নদের তীরে রবী ঠাকুরের এ পতিসর কুঠিবাড়ী অবস্থিত। পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত কালিগ্রাম পরগনার জমিদারী দেখাশোনার জন্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯১ সালে সর্বপ্রথম পতিসরে আসেন। যে ভাবে অাসলাম —
আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিল, নদী সব মিলিয়ে তাদের স্বীয় সৌন্দর্য বিলিয়েরাস্তার দু’ধারে তালগাছের সারি, রোপণ করেছে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এসব দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে যাই রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য পতিসরে। প্রবেশপথে একজোড়া সিংহের মূর্তি আমাদের স্বাগতম জানাল।
দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই মাঝের ফাঁকা জায়গায় দেখা পেলাম গুরুদেবের কংক্রিটের ভাস্কর্য। সেখানে কিছু সময় থমকে দাঁড়ালাম আমরা। আমি আবার সেই মুহূর্তকে ক্যামেরায় ধারণ করার চেষ্টা করলাম। দরজার দু’পাশে আছে মার্বেল পাথরে খোদিত পতিসরে সৃষ্ট রবীন্দ্র রচনার কিছু কথা। এক নিঃশ্বাসে পড়ে নিলাম সেসব। আমরা এগিয়ে চললাম সামনের দিকে।
এখানে রবীন্দ্র ব্যবহৃত আরাম কেদারা, লোহার সিন্দুক, গ্লোব, বাথটাব, বিভিন্ন চিঠিপত্রের অনুলিপি, পদ্মা বোটের নোঙর, জানালার কাচ ইত্যাদি বস্তুসামগ্রী পরম যত্নে সংরক্ষিত আছে। সামনে এসে দেখা মিলল রবীন্দ্রনাথ মাথা উঁচু করে যেন দাঁড়িয়ে আছেন এবং আমাদের অভয়বাণী দিচ্ছেন।জমিদারী দেখা শোনার জন্য এলেও প্রকৃতি ও মানব প্রেমী কবি অবহেলিত পতিসর এলাকার মানুষের জন্য দাতব্য চিকিৎসালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা সহ অনেক জনহৈতিষি কাজ করেন। ১৯০৫ সালে এখানকার কৃষকের কল্যানে এখানে একটি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। তবে সবচেয়ে আকর্ষন এবং নওগাঁ জেলাকে গর্ব করে বলতে হয় ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ যে নোবেল পুরস্কারের ১ লক্ষ ৮ হাজার টাকা দিয়ে সেই কৃষি ব্যাংকে বিনিয়োগ করেন। শুধু তাই নয় কুটি বাড়ির সামনে নাগর নদীর কুলে বসে কবিতা লিখেন- আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। জলপথে তাঁর সঙ্গী ছিল প্রিয় বোট ‘পদ্মা’। আরও একটি ছোট নৌকা ছিল। নৌকায় বসেই নাগরের আশেপাশের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে তিনি রচনা করেছেন অনেক বিখ্যাত লেখা। নাগর নদীতে প্রিয় ‘পদ্মা বোট’-এ বসে তিনি রচনা করেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে’। কবিতার সেই তালগাছটি আজ আর নেই। তবে তাঁর স্মৃতিঘেরা নাগর নদী আজো প্রবাহমান।
রবি ঠাকুর পতিসরে কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। কবির সাহিত্য সৃষ্টির একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে পতিসর। লিখেছেন ‘বিদায় অভিশাপ’, কাব্যগ্রন্থ চিত্রা, উপন্যাস গোরা ও ঘরে বাইরে-এর অনেকাংশ। ছোটগল্প প্রতিহিংসা ও ঠাকুরদা। প্রবন্ধ ইংরেজ ও ভারতবাসী। গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার নিভৃত সাধনা, বধূ মিছে রাগ করো না, তুমি নবরূপে এসো প্রাণে ইত্যাদি। এই পতিসরে বসেই চৈতালী কাব্যের ৫৪টি কবিতা লিখেছেন। লিখেছেন সন্ধ্যা, দুই বিঘা জমি -এর মতো অনেক বিখ্যাত কবিতা।
কুটিবাড়ীর ভিতরে প্রবেশ মূল্য- সর্বসাধারণ ১৫ টাকা মূল্যের টিকিট সংগ্রহ করে জাদুঘর পরিদর্শন করতে পারবে। সার্কভুক্ত দেশের পর্যটকদের জন্য প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা, অন্য বিদেশি পর্যটকদের জন্য ১০০ টাকা এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঁচ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।