শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধ করেছি – বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এমন একটি বক্তব্য দেয়ার পর এটি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন গণতন্ত্র কখনো শক্তিশালী ভিত না পাওয়ার কারণেই বাংলাদেশে প্রায়শ বিদেশি শক্তিগুলো প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তন, পরবর্তীতে একাধিক সামরিক শাসন, ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের পতন, এমনকি ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর প্রতিটি রাজনৈতিক সঙ্কটে এবং কম বেশি সব নির্বাচনকে ঘিরে প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে বিদেশিদের তৎপরতা আলোচনায় এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলছেন বাংলাদেশসহ ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিলো এমন বেশিরভাগ দেশেই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত হতে পারেনি বলেই বিদেশি শক্তিগুলো প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায়।
আবার তার মতে এসব দেশের তুলনামূলক দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থাও একটা বড় কারণ যার সুযোগ প্রভাবশালী দেশ বা গোষ্ঠীগুলো নিয়ে থাকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র না থাকা আর দেশটির ভূ রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বিদেশিদের প্রভাব এড়ানো যায় না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘকাল দুটি শ্লোগান ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। একটি হলো ‘রুশ ভারতের দালালেরা-হুঁশিয়ার সাবধান’ আর অন্যটি হলো ‘ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-নিপাত যাক, নিপাত যাক’।
অর্থাৎ এখানে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে হয় রাশিয়া ও ভারতের না হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষাকারী এজেন্ট বা দালাল হিসেবে প্রকাশ্যেই চিত্রিত করতো।
মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, বাংলাদেশ আমলে মূলত এটি শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ থেকেই যখন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর রাশিয়া ও ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো।
“মূলত মুক্তিযুদ্ধের পরে সরকার রাশিয়া ভারতের একচ্ছত্র সমর্থন পেয়েছিলো। বিরোধীরা সেটাকেই শ্লোগানে পরিণত করেছিলো। এরপর আওয়ামী লীগকে দীর্ঘকাল ধরে তার বিরোধীরা ভারত ঘনিষ্ঠ হিসেবে প্রচার করেছে,” বলছিলেন তিনি।
আবার ১৯৭৫ সালের পর পুরো দৃশ্যপট বদলে যায় এবং সামনে চলে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এরপর দীর্ঘকাল সামরিক শাসনে বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান পর্যন্ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শ্লোগানে উত্তপ্ত ছিলো রাজপথ।
এসব কারণে জনমনেও বিভিন্ন দলের বিদেশি শক্তিপ্রীতির দিকগুলো নানাভাবে চিত্রিত হয়েছে।বামপন্থী কিছু রাজনৈতিক দলতো চীন বা রাশিয়াপন্থী হিসেবে প্রকাশ্যেই পরিচিত ছিলো।
এক পর্যায়ে ভারত হয়ে পড়ে এ অঞ্চলের প্রভাবশালী রাষ্ট্র। আর ভারতের প্রভাব ঠেকাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে চীনও।
ফলে বাংলাদেশেও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ভারত আর চীন হয়ে ওঠে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
মহিউদ্দিন আহমদের মতে, বাংলাদেশে এখন যে সরকার আছে তাতে ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। দুই হাজার আঠারো সালের নির্বাচনের আগে তখনকার ভারতীয় কর্মকর্তা সুজাতা সিংয়ের তৎপরতাতেও কোন রাখঢাক ছিলো না বলে বক্তব্য মি. আহমদের।
অন্যদিকে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন তারা ‘লুক ইস্ট পলিসি’ নিয়েছিলো। সেখানে চীনের প্রতি তাদের আস্থা বেশি প্রকাশ পেয়েছিলো।
যদিও ড. শান্তনু মজুমদার বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মোটামুটি ভারসাম্য রক্ষা করে আসছিলো।
তার মতে অর্থনৈতিক অবস্থা যখন একটু একটু ভালো হচ্ছিলো তখন অনেক সময় ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে শক্ত কথাও বলতে দেখা গেছে মাঝে মধ্যে। আসলে অর্থনীতি ভালো হলে তখন আর কারও দ্বারস্থ হওয়ার দরকার হয় না, বলছেন ড. মজুমদার।
“সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবশালী দেশগুলো সবসময় সক্রিয় থাকে। তারা চায় অন্য দেশের সরকারগুলো তাদের ঘনিষ্ঠ হোক। আবার দেশের অভ্যন্তরে যারা রাজনীতি করে তারা চিন্তা করে ‘বড় ভাই’দের কাছে না গেলে আমার কোন পরিণতি হয় কে জানে। এসব কারণেই দেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের প্রভাব বাড়তে থাকে”।
মহিউদ্দিন আহমেদ অবশ্য স্পষ্ট করে বলেছেন যে ‘বাংলাদেশে এখন যে সরকার আছে সেটি ভারতীয় সমর্থনপুষ্ট’ এবং এটি যারা সমর্থন করে তারাই ভারতপন্থী আর যারা বিরোধিতা করে তারা ভারতবিরোধী।
আর যারা ভারতবিরোধী তাদের কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক অঙ্গনে পাকিস্তানপন্থী হিসেবে পরিচিত।
মিস্টার আহমেদ বলছেন, নতুন বৈশ্বিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের প্রবল আগ্রহ এখন বাস্তবতা।
বিশ্লেষকরা অনেকে মনে করেন আগে আওয়ামী লীগকে ভারতের সমর্থনপুষ্ট হিসেবে তার প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতারা প্রচার করলেও ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর বিএনপিও নানাভাবে চেষ্টা করেছে ভারতের সমর্থন আদায়ের।
দলটির প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন প্রকাশেই ভারতের প্রতি কাউকে ‘ব্লাইন্ড সাপোর্ট’ না দেয়ার আহবান জানিয়েছিলেন যা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো।
এর আগে পরে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে বিদেশিদের মধ্যস্থতা করা কিংবা সিভিল সোসাইটিগুলোর মাধ্যমে চাপ তৈরি করা এমন অনেক কিছুই আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে।
দুই হাজার সাত সালের ১১ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে ক্ষমতায় এসেছিলো তার পেছনেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা ছিলো। তখন বিদেশি কূটনীতিকরা প্রকাশ্যেই দলগুলোর সাথে আলোচনা করেছেন রাজনৈতিক বিষয়ে।
দুই হাজার ছয় সালের শেষ দিকে এবং ২০০৭ সালের প্রথম দিকে ঢাকায় নিযুক্ত পশ্চিমা দেশের কিছু কূটনৈতিক ছিলেন বেশ তৎপর।
এদের মধ্যে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিস, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী এবং ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রেনাটা লক ডেসালিয়ান ছিলেন সবচেয়ে বেশি সক্রিয়।
রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য তারা দফায়-দফায় খালেদা জিয়া এবং হাসিনার সাথে বারবার বৈঠক করেছেন।
উইকিলিকসে প্রকাশিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিসের গোপন তারবার্তা থেকে জানা যায়, ঢাকাস্থ পশ্চিমা কূটনীতিকরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য নিজেদের মধ্যে নিয়মিত বৈঠক করতেন। যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘কফি গ্রুপ’।
এর সাথে সম্পৃক্ত ছিল আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধি। এই গ্রুপে জাপানকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে নানা আয়োজন করেন ঢাকাস্থ পশ্চিমা কূটনীতিকরা।
বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে তারা প্রায়ই বিবৃতি দিতেন।
বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক যাতে একই ধরণের উদ্বেগ প্রকাশ করে সেজন্য পদক্ষেপ নিতে ঢাকাস্থ কূটনীতিকরা লন্ডন এবং ওয়াশিংটনকে জানান।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গোপন তারবার্তা থেকে জানা যায়, সৌদি আরবের পররাষ্ট্র দফতর কিংবা ঢাকাস্থ সৌদি দূতাবাস যাতে পশ্চিমাদের মতো উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেয় সেজন্য পদক্ষেপ নিতে ওয়াশিংটনকে পরামর্শ দেয়া হয়।
দুই হাজার সাত সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা একটি বিবৃতি দেন যাতে সতর্ক করা হয় যে ২২শে জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিষয়টি তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের বইতেও উঠে এসেছে।
এ বিষয়টি তখনকার বিএনপি মনোনীতি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিদায় নিশ্চিত করে দেয়।
শান্তনু মজুমদার বলছেন, “ধরুন একটি সামরিক প্রভাবশালী রাষ্ট্রের কথা শোনা হলো না তখন সে হয়তো অর্থনীতিতে বাধা তৈরি হয় এমন পদক্ষেপ নেবে। কিংবা অন্য কোন উপায়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করবে”।
“আবার কেউ হয়তো হুট করে বাংলাদেশের জন্য জরুরি কোন পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি বন্ধ করে দেবে যাতে সরকার বিপাকে পড়ে যায়। এ কারণে একটি ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। আবার একই কারণে রাজনৈতিক দলগুলোরও চেষ্টা থাকে প্রভাবশালীদের সন্তুষ্ট রাখতে”।
“আবার সমর্থন না করে চুপ থাকলেও হবে না। কারণ বড় ভাইয়ের কাছে না গেলে সেটি তারা ভালোভাবে নাও নিতে পারেন। এ কারণেই বৈশ্বিক রাজনীতিতে অ্যাকটিভ প্লেয়ারদের নিয়ন্ত্রণ এড়ানো কঠিন হয় অনেক সময়।”
তবে তিনি মনে করেন, এখন বিদেশি প্রভাব ইস্যুতে রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটিসহ সবার মধ্যে আরও পরিপক্বতা আসা দরকার।
সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশী কয়েকজন ব্যক্তির ওপর মর্কিন নিষেধাজ্ঞাকেও অনেকে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে চাপ তৈরির কৌশল বলে বর্ণনা করেন অনেক বিশ্লেষক। যদিও এর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গুলো শক্তিশালী হয়ে গণতন্ত্র কার্যকর না হলে সেটিও হওয়া কঠিন বলে মনে করেন লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ।
সে কারণে আরও কিছুকাল প্রভাবশালী বিদেশি দেশগুলোর সমর্থন আদায় নিয়ে প্রতিযোগিতাও বড় দলগুলোর মধ্যে চলতে থাকবে বলে মনে করেন তিনি।বিবিসি বাংলা