ভোটের কারণে দেশের রাজনীতি কার্যত দুই ধারায় বিভক্ত। একদিকে আওয়ামী লীগ, কিছু বাম দল ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী কিছু সংগঠন; অন্যদিকে রয়েছেবিএনপি, জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষ, ইসলামী ধারার দল ও পীর-মশায়েখ। দেশের অনেক শায়েখের মতে জামায়াতে ইসলাম প্রকৃত ইসলামী দল নয়। সে কারণে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে বিএনপির থেকে অনেক ইসলামী ধারার দল দূরে সরে যায়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনীতিক ও আলেম সমাজকে ১৯ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপির ছায়াতলে এনেছিলেন। পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়াও এই ধারাতেই এগিয়ে গেছেন। কিন্তু বর্তমান বিএনপির নেতৃত্ব তথাকথিত আধুনিকতার নামে সেই অবস্থা থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে সরে গেছে। দলটি প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকলেও শক্র-বন্ধু চিনতে পারছে না। এখনো বিদেশেীদের সহায়তার ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই সঙ্গে জনসমর্থনহীন কিছু বাম দলের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছে। ফলে জামায়াত ও বামদের সঙ্গে বেশি মাখামাখির কারণে ভোটের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ধারার দলগুলো কিছুটা দূরে সরে যায়। নিজের থেকে জামায়াত সরে যাওয়ায় বিএনপির সামনে এখন সুবর্ণ সুযোগ ইসলামী ধারার দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনার পথ তৈরি হলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াত চলে যাওয়ায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট ও অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনকে বিএনপির সঙ্গী করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
বিগত শতকের নব্বই দশকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত সংসদে ও রাজপথে বিএনপির বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন করেছে। কিন্তু ’৯৬ সালে জাতীয় পার্টি ও জাসদের সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ ঐকমত্যের সরকার গঠন করার পর আওয়ামী লীগ দূরে ঠেলে দেয় জামায়াতকে। অতপর ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (মরহুম) জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম (মরহুম) এবং ইসলামী ঐক্যজোটের তৎকালীন চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হক (মরহুম) সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করেন বিএনপিচেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। পরে ২০ দলীয় জোট গঠন করা হয়। এর মধ্যেই দীর্ঘদিন ধরে টানাপড়েন চলছিল ২০ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। তবেবিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে কেউ এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। কিন্তু সম্প্রতি দলীয় এক সভায় ভার্চুয়ালি বক্তব্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেন জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা এতোদিন একটা জোটের সঙ্গে ছিলাম। ছিলাম বলে আপনারা হয়তো ভাবছেন কিছু হয়ে গেছে নাকি? আমি বলি হয়ে গেছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি একটি জোট ছিল। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর জোট তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়ে ছিল। সেটা আর ফিরে আসেনি। বছরের পর বছর পর এ ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না। এই জোটের সঙ্গে বিভিন্ন দলে যারা আছেন, বিশেষ করে প্রধান দলের (বিএনপি) এই জোটকে কার্যকর করার কোনো চিন্তা নেই। বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট দিবালোকের মতো এবং তারা আমাদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন বাস্তবতা হচ্ছে, নিজস্ব অবস্থান থেকে আল্লাহর ওপর ভর করে পথ চলা। তবে হ্যাঁ জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবো ইনশাআল্লাহ।’
বিএনপির সঙ্গে জোট নিয়ে আলোচনা হয়েছে দাবি করে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা তাদের (বিএনপি) সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছি, এর সাথে তারা ঐকমত্য পোষণ করেছে। তারা আর কোনো জোট করবে না। এখন যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করা। যদি আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করেন, তাহলে আমাদের আগামী দিনগুলোতে কঠিন প্রস্তুতি নিতে হবে এবং অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। দোয়া করেন, এসকল ত্যাগ যেনো আল্লাহর দরবারে মঙ্গলজনক হয়। এ ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহপাক যেন আমাদের পবিত্র একটি দেশ দান করে। যে দেশটা কোরআনের আইনে পরিচালিত হবে।’
জামায়াত আমীরের দেয়া বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আবু মিশকাত লিখেছেন, ‘বিএনপির জন্য এটা খুবই ভালো হলো…।’ আশিক লিখেছেন, ‘খবরটি যদি সত্যি হয়, তাহলে উভয়ের জন্য ভালো।’ মো. ফরিদ মিয়া লিখেছেন, ‘খুব ভালো সিদ্ধান্ত, জামায়াত জোট ছাড়ায় নিজেদের জন্য মঙ্গলজনক।’ তারেকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই।’ মো. রহিম উদ্দীন লিখেছেন, ‘জামায়াত-বিএনপি ভাই ভাই ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। এখন সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে যুগপৎ আন্দোলনের। বিভাজন করে দেশকে আওয়ামী হায়েনাদের কাছ থেকে মুক্ত করা যাবে না।’ মিন্টু সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘এটি একটি ভালো সংবাদ। যার যার অবস্থান থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাবে, তাতে তো কোনো সমস্যা নেই।’ ফয়সাল লিখেছেন, ‘জামায়াত কাজটি ভালো করেছে। এককভাবে নির্বাচন করুক। তাও বাংলাদেশের মানুষ দেখবেÑ জামায়াত কতটুকু শক্তিশালী। জামায়াত অতীতে অনেক নির্বাচনে ভালো ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে। বিএনপির ব্যর্থতা জামায়াতকে এতো দিন নিতে হয়েছে।’ মো. হান্নান লিখেছেন, ‘জামায়াত এখন পর্দার আড়ালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে কি-না দেখার বিষয়।’ জামায়াতের জোট ছাড়ার ঘোষণার খবরে এমন হাজার হাজার মন্তব্য বক্তব্য নেটিজেনরা নেট দুনিয়ায় করেই যাচ্ছেন।