রাশেদুজ্জামান,নওগাঁ জেলা প্রতিনিধিঃমিনিকেট নামে চাল বাজারজাত বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট ধানের জাত উল্লেখ করে চাল বাজারজাত করার কথা বলা হচ্ছে। কয়েকজন মন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবও বিষয়টি নিয়ে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। এ-সংক্রান্ত একটি আইনও এখন প্রক্রিয়াধীন। তবে সরকারের এ উদ্যোগের বিপরীতে তীব্র প্রতিক্রিয়া
জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রীর জেলা নওগাঁর চালকল ব্যবসায়ীরা। অটোমেটিক রাইস মিল মালিক সমিতি ও নওগাঁ ধান্য-চাউল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা এনিয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। মিনিকেট চাল নিয়ে ওঠা বিতর্ককে চালকল ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে গভীর যড়যন্ত্র বলে অভিযোগ করেছেন তারা।মিনিকেট নামে ধানের কোনো জাত নেই। অভিযোগ উঠেছে, বিভিন্ন জাতের চালকে মেশিনে পলিশ করে সেগুলো মিনিকেট নামে বাজারজাত করা হয়। এতে চালের পুষ্টি কমে যায়। যদিও চাল ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশী চালকল শিল্পকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে এবং চালকল মালিকদের হেয় করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে অবৈজ্ঞানিক ও
বাস্তবতাবিবর্জিত কথা বলা হচ্ছে।নওগাঁর ধান্য-চাউল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির ভবনে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ের আমলারা বলছেন,
মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই। অথচ তারা এটা স্পষ্ট করছেন না যে মিনিকেট নামে বাজারে প্রচলিত চাল কোন ধান থেকে উৎপাদিত। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে বাজারে কম-বেশি মিনিকেট চাল আছে। তারা উত্তরাঞ্চলের নাটোর, নন্দীগ্রাম, সিংড়া, রনবাঘা, চৌবাড়িয়া এবং কুষ্টিয়ার বিভিন্ন বাজারে কৃষকদের কাছ থেকে মিনিকেট ধান কিনছেন। তাহলে এটা কোন ধান? আবার
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে, মেশিনে চাল ছাঁটাই কিংবা সুপার পলিশ করে চাল ছোট বা চাপ প্রয়োগ করে লম্বা করা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো দেশের কোনো চালকলে চাল ছাঁটাই বা লম্বা করার কোনো মেশিন নেই।বাজারে মিনিকেট নামে প্রচলিত চাল মূলত জিরাশাইল ধান থেকে আসে দাবি করে তারা বলেন, পর্যাপ্ত সেচ সুবিধার কারণে গোটা উত্তরাঞ্চলে ইদানীং ব্যাপক হারে জিরাশাইল ধানের চাষ হচ্ছে। এ জিরাশাইল ধানই দেশের কোনো কোনো অঞ্চলেরকৃষকরা মিনিকেট নামে বাজারে বিক্রি করছেন। এ কারণে জিরাশাইল ধান থেকে উৎপাদিত চাল কোথাও মিনিকেট আবার কোথাও জিরাশাইল নামে বিক্রি হচ্ছে।এসময় তারা অভিযোগ করেন, মিনিকেট চালের মতো প্রায় ৫০ বছর ধরে নাজির চাল বিক্রি হচ্ছে। নাজিরও একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নাজির নামে কোনো ধান নেই। চালকলে উৎপাদিত এক সেদ্ধ দেয়া বিভিন্ন জাতের ধানের চালকে নাজির বলা হয়। যেমন কাটারি ধানের এক সেদ্ধ চাল কাটারি নাজির, পাইজামের এক সেদ্ধ চাল পাইজাম নাজির, বিআর-২৮ ধানের এক সেদ্ধ চালকে আটাশ নাজির বলা হয়। কিন্তু বাজারে গিয়ে ক্রেতারা কেউ বলে না যে পাইজাম নাজির, আটাশ
নাজির বা কাটারি নাজির চাই। তারা নাজির চাল চান। বাজারে প্রচলিত নাজির
চাল উৎপত্তির জন্য চাল ব্যবসায়ী বা চালকল মালিকরা দায়ী নন। একইভাবে বলা চলে,
বর্তমানে অধিকাংশ কৃষক সুগন্ধি ধান হিসেবে ব্রি-ধান-৩৪ চাষাবাদ করছেন।
অথচ বাজারে সে চাল চিনিগুঁড়া হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা
চিনিগুঁড়া চাল নিয়ে কোনো কথা বলছেন না। তাহলে কি নাজির ও মিনিকেট
চাল নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে?সংবাদ সম্মেলনে বেলকন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা
পরিচালক বেলাল হোসেন বলেন, বিভিন্ন জাতের ধানের চাল কেটে নাকি
মিনিকেট চাল তৈরি করা হয় এমন কথা বলা হচ্ছে। আমার মিলে যে মিনিকেট চাল
উৎপন্ন হয়, সেটি মেশিন দিয়ে কেটে ছোট কিংবা লম্বা করা হচ্ছে কিনা তা
দেখার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানকে আমার পক্ষ থেকে
স্বাগত জানাতে চাই। এর আগেও ১০ বার এ পরীক্ষা দিয়েছি। আবার পরীক্ষা দিতে
রাজি আছি।নওগাঁ ধান্য-চাউল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ
বরণ সাহা চন্দন বলেন, সম্প্রতি মিনিকেট ও নাজির চাল নিয়ে যে ধরনের বক্তব্য ও
সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে তাতে চাল ব্যবসায়ীদের হেয় করা হয়েছে। বলা হচ্ছে চাল
কেটে মিনিকেট তৈরি হচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, বিভ্রান্তিমূলক ও
বাস্তবতাবিবর্জিত। বাস্তবতা হলো চাল কেটে ছোট কিংবা লম্বা করার কোনো
মেশিনই এখনো আবিষ্কার হয়নি। তবে চাল ভেঙে খুদ করা যেতে পারে। এ ধরনের
সংবাদ প্রকাশের ফলে জেলায় চাল ব্যবসার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এতে ব্যবসায়ীরা
ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। বাজারে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে।দেশে
চালের সবচেয়ে বেশি সরবরাহ আসে নওগাঁ জেলা থেকে। আবার সীমান্তবর্তী এ
জেলায় ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে আমদানীকৃত চাল প্রবেশ করছে। মূলত এ
অঞ্চলের মিল মালিকদেরই দেশের চালের বাজারে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী বলে ধরা হয়।
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের তথ্যমতে, জেলাটিতে হাস্কিং মিল রয়েছে
৮০০টি এবং অটো রাইস মিল রয়েছে ৫৬টি।বর্তমানে জাতীয় ভোক্তা অধিকার
সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো মিনিকেট চাল নিয়ে অনুসন্ধান
চালাচ্ছে। এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক
এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, আমরা এখনো মিনিকেট চালের ব্যাকগ্রাউন্ড
নিয়ে কাজ করছি। কাজ শেষ হয়নি। কৃষিমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব
বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে বলেছেন। সাতক্ষীরার একটা ঘটনায় দেখা গিয়েছে যে
মিনিকেটের প্যাকেটে বিআর-২৮ জাতের চাল দিয়েছে। এটা আমরা আমলে
নিয়েছি। মিনিকেটের বিষয়ে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি, শেষ হলে বলা যাবে।খাদ্য
মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, মিনিকেট কোনো ধানের জাত
নয়। অনেকে বলছে ব্র্যান্ড। কিন্তু ব্র্যান্ড যদি হয়, তাহলে সব প্রতিষ্ঠানের নাম তো
এক হওয়ার কথা না। একেক প্রতিষ্ঠানের নাম তো একেক রকম হবে। যার যার মতো
করে যদি নাম দিতে পারে, তাহলে করুক। সেখানে ধানের জাতও উল্লেখ করা থাকতে
হবে। এটাই মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন। এটাই মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টি জানেন। এখন আমরা আইনগতভাবে চেষ্টা করছি সেটা
কীভাবে কাভার করতে পারব। খাদ্যমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে মিনিকেট নিয়ে বলেছেন।
খাদ্য মন্ত্রণালয় একা কিছু করবে না। বরং ভোক্তা অধিকার ও সংশ্লিষ্ট সবাই মিলেই
এ ব্যবস্থা নেয়া হবে।তিনি বলেন, চাল কাটা হয় না। মূলত পলিশ করার কথা বলা
হচ্ছে। মেশিনে পলিশ করলে ওপর থেকে একটা লেয়ার কমে যায়। ওপরের লেয়ারে চালের
পুষ্টি থাকে। এর ফলে আসলে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের চার কোটি টন চাল
উৎপাদন হলে এর মধ্যে ৩০-৪০ লাখ টন চাল চলে যাবে ওপরের লেয়ার ফেলে দেয়ার কারণে,
যদি সব চাল মিনিকেট করা হয়। আমাদের কোনো কোনো বছর চালের ঘাটতিই
হয় ১০ লাখ টন। ফলে এখান থেকে চাল বাঁচাতে পারলে কিন্তু এ ঘাটতি থাকবে না।
আর পুষ্টির দিক তো আছেই। এ কারণেই আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ জেলা
প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ একটা ফ্রেমওয়ার্কে আনতে চাচ্ছি।
জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা লাগবে।এ বিষয়ে একাধিকবার চেষ্টা করেও
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে মন্ত্রণালয়ের
জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলেও তিনি মন্তব্য করতে রাজি
হননি।