জোবায়েদ হোসেন, নওগাঁ বিশেষ প্রতিনিধি : ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘের শাখা নদীর মাঝখানে ৬ বছর যাবত খাড়া অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে দুটি পিলার। দূর থেকে দেখলে এটাকে খাম্বা ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। এই শাখা নদীর মাঝখান দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে হেঁটে পার হতে পারলেও বর্ষা মৌসুমে ৫ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ওপারে যেতে হচ্ছে পথচারীদের। শাখা নদীটি খননের দীর্ঘ ২৮ বছরেও প্রত্যাশিত ফুট ব্রিজ না পাওয়ায় এমন দুর্ভোগে রয়েছেন নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার কাশিমপুর ও গোনা ইউনিয়নের ১০ গ্রামের স্কুল ও কলেজ পড়ওয়া শিক্ষার্থীসহ কৃষি নির্ভর সাত হাজার পরিবার। এলাকাবাসীর উন্নয়ন ও দুর্ভোগ লাঘবে দ্রুত ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শেষ করে চলাচলের উপযোগী করার দাবী স্থানীয়দের।উপজেলা পরিষদ ঘুরে তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৬ সালে সর্বরাম গ্রামে ফুট ব্রিজ নির্মাণে উপজেলা পরিষদের বার্ষিক উন্নয়ন তহবিল (এডিপি) থেকে প্রায় ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ওই বছরের মার্চ মাসে ব্রিজপি নির্মাণে দরপত্র আহবানের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করে এলজিইডি। কাজটির ঠিকাদারী দায়িত্ব পেয়েছিলেন নওগাঁ শহরের পার-নওগাঁ মহল্লার গোলাম কিবরিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। উপজেলা প্রকৌশলীর তক্তাবধায়নে ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শুরু হলেও রহস্যজনক কারণে কাজটি সমাপ্ত না করে সেখানে শুধুমাত্র দুটি পিলার নির্মাণ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এস্টিমেটসহ দরপত্র বিবরণীর ফাইলটিও উপজেলা পরিষদ থেকে রাতারাতি গায়েব হয়ে যায়। কাজ শেষ না করলেও ঠিকাদারকে সম্পূর্ণ বিল দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘ ৬ বছর পর চলতি বছর উপজেলা পরিষদের বার্ষিক উন্নয়ন তহবিল (এডিপি) থেকে ব্রিজটির আরো দুইটি পিলার নির্মাণের জন্য আবারো সাড়ে ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে এলজিইডির তক্তাবধায়নে নিয়ম মেনে দরপত্র আহবানের মধ্য দিয়ে কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু না করা ও বাড়তি সময়ের আবেদন না করায় সম্প্রতি চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাণীনগর উপজেলার ছোট যমুনার নদীর কুজাইল সুইজগেট থেকে শুরু হয়ে রক্তদহ বিলে গিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে শাখা নদী শেষ হয়েছে। ১৯৯৪ সালের শুরুর দিকে স্থানীয়দের কৃষি জমিতে সেচ ব্যবস্থা ও নৌ চলাচলের স্বাভাবিক গতি ধরে রাখার জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের এর উদ্যোগে শাখা নদীটি খনন করা হয়। বর্তমানে এই শাখা নদীটি রতনডারি খাল নামে পরিচিত। এ খালটি উপজেলার কাশিমপুর ও গোনা ইউনিয়নের প্রায় ১০টি গ্রামের ১৫ হাজার মানুষকে পৃথক করেছে। খালের দক্ষিণ পাড়ে গোনা ইউনিয়নের ভবানিপুর গ্রাম এবং উত্তর পাড়ে কাশিমপুর ইউনিয়নের সর্বরামপুর গ্রাম। দীর্ঘদিন থেকে এখানে কোন ব্রিজ না থাকায় গোনা ইউনিয়নের ভবানিপুর, বেতগাড়ি, বয়না, হঠাৎপাড়া ও ডাঙ্গাপাড়া গ্রাম এবং উত্তর পার কাশিমপুর ইউনিয়নের সর্বরামপুর, কাশিমপুর, এনায়েতপুর ও কুজাইল গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীদের চলাচলসহ ৭ হাজার কৃষক পরিবারের কৃষি পণ্য পরিবহণে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। চৈত্র থেকে আষাড় মাস পর্যন্ত রতনডারি খালে পানি থাকে না। এসময় নির্মানাধীন ফুট ব্রিজের নিচ দিয়ে হেঁটে দু’পাড়ের মানুষ চলাচলা করে। তবে বর্ষা মৌসুমে নৌকাই একমাত্র ভরসা হলেও সেটিও সবসময় থাকে না। খালের দক্ষিণ পার ভবানীপুর গ্রাম থেকে খালের উত্তর পার সর্বরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পায়ে হেঁটে প্রায় ৮ মিনিটের পথ। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে কুজাইল গ্রাম হয়ে স্কুলে ঘুরে আসতে হয়। আর খুবই জরুরী হলে সাঁতার কেটে পার হয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়।ভবানীপুর গ্রামের কৃষক তোফাজল হোসেন, মজিদ, খালেকসহ অনেকেই বলেন, সর্বরামপুর গ্রামে আমাদের জমিজমা আছে। বর্ষা মৌসুমে ওইসব জমি থেকে খাল পেরিয়ে ফসল ঘরে আনতে গেলে পানিতে ভিজে যায়। পরিবহন যোগে ফসল ঘরে আনতে গেলে লাভ তো দূরের কথা লোকসানের মুখে পড়তে হয়। দীর্ঘ ২৮ বছরের প্রত্যাশিত ব্রিজটি নির্মাণ না হওয়ায় যাতায়াতসহ সর্বক্ষেত্রে ভোগান্তী পোহাতে হচ্ছে। ব্রিজ নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করার দাবী জানান তারা।স্থানীয় মেম্বার মোঃ হাফিজুর রহমান হাফিছ বলেন, ৬ বছর আগে সর্বরামপুর ফুট ব্রিজের দুইটি পিলার তৈরী করে রেখে গেছে। এরপর আর কেউই এদিকে মুখ ফিরে দেখেননি। দীর্ঘদিন নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় ব্রিজের আংশিক অবকাঠামো নষ্ট হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে ওপারে যেতে হলে সব সময় নৌকাও পাওয়া যায় না। তখন সাঁতরে ওপারে যেতে হয়, তা না হলে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূর দিয়ে ঘুরে আসতে হয়। এই ব্রীজ না থাকায় আমাদের অন্তত ১০ গ্রামের মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়নসহ অনেক নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন এভাবে ঝুঁলে আছে। ব্রীজটি দ্রুত নির্মাণ করে চলাচলের উপযোগী করার দাবী জানান তিনি।সর্বরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গুলনাহার খানম বলেন, শিশুদের স্কুলমুখী করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। আশেপাশের ৫-৬টি গ্রামের ছাত্র-ছাত্রী এখানে পড়তে আসে। বিদ্যালয়ে এসে শিক্ষার্থীরা যাতে হতাশ না হয় সেজন্য প্রতিনিয়ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে। তবে ফুট ব্রিজ না থাকায় শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়া রোধ করা যাচ্ছে না। গত দু’বছর আগেও বিদ্যালয়ে ১০৫ জন ছাত্র-ছাত্রী ছিল। বর্তমানে ৬৮ জন আছে। এরমধ্যে ২০ জন ছাত্র-ছাত্রীসহ একজন শিক্ষিকা খালের ওপারে থাকেন। বর্ষা মৌসুমে ছাত্র-ছাত্রী বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসতে পারেনা। তাদের প্রায় ৫ কিলোমিটার হেঁটে বিদ্যালয়ে আসতে হচ্ছে। এটাই মূলত ঝড়ে পড়ার মূল কারণ।স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) রাণীনগর উপজেলা প্রকৌশলী শহিদুল হক বলেন, ৬ বছর আগে ব্রিজটি নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। তবে নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ করতে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে কাজটি পিছিয়ে পড়ে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে এডিপি থেকে কিছু টাকা দিয়ে আরো দুটি পিলার নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়েছিল। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু না করায় সেটিও বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শীঘ্রই নতুন ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে কাজটি শুরু করা হবে।