সিনথিয়া সুমি
বিদায় নিচ্ছে ২০২০ সাল। এই বছরটিকে বরণ করার সময় কেউ ভাবেনি যে, বছরটি মানব জাতির জন্য এতটা বিষময় হবে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দোলাচলে কালের আবর্তে মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেল আরো একটি বছর।
২০২০ কাটলো আতঙ্ক, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে। প্রায় সারা বছরই থাকলো করোনাভাইরাসের মরণ-ভীতি। আগের বছরের একেবারে শেষ দিকে চীনের উহান শহরে যে ভাইরাস প্রথম সনাক্ত হয়েছিল, তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে খুব সময় লাগেনি। ২৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন ভাইরাসটির নাম দেয় কোভিড-১৯।
২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত শব্দ কোভিড-১৯ বা মরণব্যাধি করোনাভাইরাস। বিশ্ব অর্থনীতিকে পঙ্গু করেছে করোনাভাইরাস। পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠী, প্রায় কোটি কোটি মানুষকে মাসের পর মাস ঘরবন্দি থাকতে বাধ্য করেছে এই মহামারি । প্রায় ৮ কোটি মানুষ করোনা সংক্রমিত হয়েছেন। মৃত্যু বরণ করেছেন প্রায় ১৮ লাখ মানুষ। আরও কত মানুষের জীবন কেড়ে নিয়ে করোনা তার সংহার তাণ্ডব বন্ধ করবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না। কারণ এখন দেশে দেশে চলছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রতিদিনই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মৃত্যুবরণ করছে। নানা ধরনের দুর্যোগ-দুর্বিপাক, মহামারির অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীর রয়েছে ।
বিগত বছরগুলোর মতো ২০২০ সালেও ধারাবাহিকভাবে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, সহিংসতা, নৃশংসতা, নির্মমতা ও রক্তাক্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে। নানা ঘটন-অঘটন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, চড়াই-উতরাই, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আনন্দ-বেদনার সাক্ষী হয়ে কালের গর্ভে সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেল ২০২০। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় প্রেক্ষাপটে নানা কারণেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে বছরটি। এবার রাজনীতির মাঠ তেমন উত্তপ্ত না হলেও পৌর নির্বাচন কেন্দ্রিক উত্তেজনা বাড়ছে ক্রমশ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকায় দেশ এগিয়েছে অনেক। মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য হ্রাসসহ নানা ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশের শীর্ষে অবস্থান, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সাফল্য বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করেছে।
নববর্ষের এই সূচনালগ্নে প্রত্যাশা, জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে আত্মপ্রবঞ্চনা, অগণতান্ত্রিক ও পশ্চাৎমুখী প্রবণতার অবসান ঘটবে। সরকার জঙ্গী, মাদক ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল এবং যুদ্ধাপরাধীমুক্ত উন্নয়নশীল স্বদেশ গড়ে তুলবে। একই সঙ্গে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সকল অপতৎপরতা বন্ধ হবে। নিকট অতীতের অগ্নি সন্ত্রাসের দিন যেন আর ফিরে না আসে। শক্ত হাতে প্রতিরোধ সবাইকে গড়ে তুলতে হবে। দেশ সেবায় আত্মনিয়োগের মধ্য দিয়েই দেশকে এগিয়ে নিতে হবে সবাই মিলে।
পুরাতন বছরের অনেক ব্যর্থতা যেমন রয়েছে , আবার অনেক সফলতার রেকর্ডও আছে। ব্যর্থতাকে শিক্ষার উপকরণ হিসেবে মেনে নিয়ে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো যথাসম্ভব পরিহার করার মানসিকতা থাকতে হবে। যেসব সফলতা আছে সেইগুলোকে আরো সফলতার সাথে ব্যবহার করে জনগণের কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। আইন শৃঙ্গলা, অপরাধ দমন, নারী ও শিশু নির্যাতন, গুম-হত্যা, চুরি-ছিনতাই, সাইবার ক্রাইম, পারিবারিক অপরাধ’সহ যাবতীয় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। মেয়াদোত্তীর্ণ বা নকল ঔষধ বিক্রি, ভুয়া ডাক্তার, ভুল চিকিৎসা, ডিগ্রীবিহীন ডাক্তার, লাইসেন্স বিহীন ডায়াগ্নস্টিক সেন্টার, ডাক্তারদের মতো সেবাধর্মী পেশাজীবীদের ধর্মঘট ইত্যাদি থেকে জনগণকে রেহাই দিতে হবে। সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল রাখার মাধ্যমে জনবান্ধব পরিবেশ সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা। শিক্ষা ব্যবস্থায় গলদ, প্রশ্ন ফাঁস’সহ যাবতীয় অপরাধকে শূন্যের কোঠায় আনতে হবে। মানসম্পন্ন ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ করে শিক্ষা ব্যবস্থায় ও ব্যবস্থাপনায় যৌক্তিক পরিবর্তন সময়ের দাবি। নৈতিক চরিত্র গঠনে সহায়ক ও সময় উপযোগি কারিকুলাম তৈরী করে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে হবে।
মাদকের করাল গ্রাস থেকে যুব সমাজকে বাঁচাতে হবে। ইয়াবা, গাঁজা, ফেন্সিডিল’সহ সব ধরনের ভয়াবহ মাদকের সহজ লভ্যতা বন্ধ করতে হবে। মাদকের হাত থেকে তরুণদের রক্ষা করতে না পারলে মাদকে আসক্ত ও অর্থব্য যুবসমাজ দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন কিভাবে বাস্তবায়ন হবে? ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতি ও অর্থ পাচার রোধ করে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের সুবিধা প্রদান, ব্যাংকে অর্থ লগ্নি লাভজনক ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ভ‚মি দস্যু, বনদস্যু, খাল ও হাওড় দস্যুদের হাত থেকে খাস জমি রক্ষা করা ও ভূমিহীন প্রান্তিক চাষীদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। সকল পর্যায়ে ঘুষ বাণিজ্য ও দুর্নীতি রোধকল্পে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে স্বাধীনতার চেতনার বাস্তবায়নে চাই কার্যকর পদক্ষেপ। সকল ধরণের বৈষম্য ও নৈরাজ্য দূর করে দারিদ্রতার করাল গ্রাস থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ব্রতি হতে হবে।
আমরা সব সময় পুরনো জিনিসটার চেয়ে আরো নতুন এবং ভালো জিনিসটাই খুঁজি। নতুনটাই গ্রহণ করি। ঠিক সেভাবে ২০২০ সালের সব ভুলভ্রান্তি ভুলে গিয়ে আমরা পেতে চাই আরো সুন্দর ও সাজানো-গোছানো একটি বছর। এ জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা। কারণ পরিকল্পনা ছাড়া কিছুই সঠিকভাবে সফল করা যায় না। তাই নতুন বছরটা শুরু করতে হবে সুন্দর পরিকল্পনা দিয়ে। আর এই পরিকল্পনায় থাকতে হবে তরুণদের কিছু ভাবনা। নতুন বছরটা যেন তরুণদের কথা মাথায় রেখে শুরু করে সরকার, সেটাই প্রত্যাশা। তরুণদের কথা মাথায় রেখে সোনার বাংলা গড়তে হবে। দেশের উন্নয়ন করতে হলে অবশ্যই তরুণদের সঙ্গে নিয়ে এগোতে হবে। তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে প্রচুর। বেকার তরুণ যুবকদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে নতুন বছরে।
নতুন বছরটা হোক তরুণদের জন্য আশীর্বাদের বছর। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম কিন্তু কথায় নয়, কাজে বিশ্বাস করে। তাদের আশ্বাস দিলে চলে না, বিশ্বাস দিতে হবে। সোনার বাংলা গড়ার কারিগর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই তাঁর তরুণ বয়সে দেখিয়েছেন তরুণরা কতটা করতে পারে দেশের জন্য। আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবনী পড়লেই জানতে পারব, তরুণ বঙ্গবন্ধু কতটা সফল ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বর্তমান তরুণ প্রজন্মও সফল হতে চায়।
সংক্ষিপ্ত ভাবে বলা যায়, ২০২০ সাল বিশ্বব্যাপী ছিল মূলত করোনা মহামারীর বছর। এই অতিমারী বিশ্বের অগণিত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। সংক্রমিত করেছে অসংখ্য মানুষকে, যা চলমান। যার কারণে ক্ষতি হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থার এবং ইত্যাদি ইত্যাদি কিছুর। আশার কথা এই যে, বছর শেষে কোভিড-১৯-এর টিকা আবিষ্কার এবং এর প্রয়োগও শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও আসবে অচিরেই। বাংলাদেশও নতুন বছরের শুরুতেই ভ্যাকসিন পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। সমতার ভিত্তিতে সবার কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছাতে কত সময় লাগবে, এটা কতটা সহজলভ্য হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও আশাহত হওয়ার কিছু আছে বলে মনে হয় না। ২০২১ সালে এর প্রশমন ঘটবে, এমনটাই প্রত্যাশা।
লেখকঃ সিনথিয়া সুমি, ইতিহাস বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-গোপালগঞ্জ।